শীতল পাটীর শীতল ছোয়া
মো:কয়েছ মিয়া :
আবহমান বাংলার লোকশিল্পের এক ঐতিহ্যর নাম শীতলপাটী । অনেক লোক ,গানে,কবিতায় নানাভাবে উচ্ছারিত হয়েছে শীতলপাটির কথা । গ্রামবাংলায় কারো বাড়ীতে নতুন অতিথি এলে শীতল পাটি বিছিয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য বহুকালের । সেই ঐতিহ্যর কথা এখন শোনা যায় লোক ছড়ার কাহিনিতে । শীতল পাটির ছোয়ায় প্রাণ জোরাতো আগেকার মানুষের । বর্তমানে শীতল পাটি শিল্পীদের জীবন একেবারেই নাজুক । জীবন এবং জীবিকার তাগিদে অনেকে বদল করেছেন এ পেশা । শীতল পাটি এক সময় এ অঞ্চলে সভ্যতার মাপকাঠি ছিল । কিন্তুু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শীতল পাটি শিল্প বাজারে প্রচন্ড মার খেতে থাকে । ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলেও শীতল পাটির কদর কম ছিলনা । পরম কাংখিত অতিথি এলে শীতল পাটিতে বসতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।বালাগঞ্জ,ওসমানীনগরেরতেঘরিয়া,আতাসন,চাঁনপুর,শ্রীনাথপুর,গৌরীপুর,মহিষাশি,বিলবাড়ি,লোহামোড়া,ঝুগিপুর,কামারগাঁও,খালিশপুর প্রভৃতি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক লোক শীতল পাটি শীল্পের সাথে জড়িত ছিল । কিন্তুু শ্রম ও বাজারমূল্যের প্রচন্ড ব্যবধান এ শিল্পীদেরকে বিমুখ করে তুলেছে । মুতর্া নামক সরু গাছ ৮থেকে ১০দিন পানিতে ডুবিয়ে রেখে রোদ্রে শুকানো হয়। এর পর মুর্তা গাছের ছাল থেকে হালকা বেত তৈরী করা হয় । তারপর বেতগুলো বিভিন্ন প্রকার রঙে রাঙ্গিয়ে শিল্পী তার দ হাতে বুনন করে একের পর এক শীতল পাটি। ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের মতো শীতল পাটিও ছিল সৌন্দযর্্য ও শীল্পের প্রতীক । ব্রিটিশ আমলে লন্ডরের রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রাসাধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল । সে এক কালের কথা ,পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বেড়াতে আসতো বণিকরা বালাগঞ্জ,ওসমানীনগরে । সেখানে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে তারা নিয়ে যেত বাহারি শীতল পাটি। ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,রাশিয়ায় শীতল পাটির কদরও ছিল ঈর্ষণীয়। ভারতবর্ষ আগমনে প্রমাণ হিসাবে ভিন দেশীরা ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি বালাগঞ্জের,ওসমানীনগরের শীতলপাটি নিয়ে যেত স্মৃতি হিসাবে । ১৯৯১সালে বিশ্বের কারুশিল্পের একটি প্রদর্শনী ইতালির রোমে অনুষ্টিত হয়ে ছিল । বিলবাড়ী গ্রামের মহিন্দ্র নাথ এদেশীয় প্রতিনিধি হিসাবে শীতল পাটি নিয়ে অংশ গ্রহন করেন । শীতলপাটির বুনন শৈলী অন্যান্য শিল্পীদের প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৮২সালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসাবে স্বীকৃতী পান তেঘরিয়ার পবন জয় দাস । শীতলপাটি হরেক রকম হয়ে থাকে এদের মধ্যে পয়সা,শাপলা,সোনামুড়ি,জয়পাটি,টিক্কা,সিকি,লালগালিচা,আধুলি,মিহি প্রভৃতির কদর ছিল বেশি। কথিত আছে এমন ভাবে মিহি ও পিচ্ছিল ভাবে তৈরী করা হতো যে একটা সাপ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারতোনা । শীতলপাটি শিল্পীরা হিন্দু সমপ্রদায় ভুক্ত । আর পাটিতে তারা নানা ধরনের মন্দিরা,ত্রিশুল ও আলপনার আদল তৈরী করত । হালের তাজ মহলও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি । শীতল পাটি শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা জানতে কথা হয় সোনামনি দাসের সাথে। তিনি বলেন একটা শীতল পাটি তৈরি করতে ১০থেকে১৫দিন লাগে । কিন্তুু বাজারে সাধারণ শীতল পাটি বিক্রি করলে ৩০০-৪০০টাকার বেশি মুল্যে পাওয়া যায় না আর সু বেতের তৈরী শীতল পাটি প্রায় ১০ থেকে ১৫হাজার টাকা বিক্রি হয়। ফলে শ্রমমুল্যে না পাওয়ায় অনেকেই এখন আর শীতল পাটি তৈরি করতে আগ্রহী নন । যার জন্য দিন দিন লোকের ঘর থেকে সরে গিয়ে শুভা পাচ্ছে ইতিহাসের পাতায় । এমন দিন ছিল বিভিন্ন খাল বিল ও লোকালয়ের পাশে শীতল পাটির প্রধান উপকরণ মুর্তা পাওয়া যেত । কিন্তুু বর্তমানে তা দুষপ্রাপ্য হয়ে উঠেছে । লোকজন নিজেদের প্রয়োজনে মুর্তা উজার করে ফেলতেছে । দরিদ্র অনেক পরিবার তাদের বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করে থাকেন । আশি সালের দিকে একবার সরকার মুর্তা উৎপাদনের জন্য ঋণ দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে আর কোন উদ্যেগ গ্রহন করা হয়নি । ফলে মুর্তা এখন নেই বললেই চলে । দূর থেকে মুর্তা ক্রয় করে আনতে যে খরছ হয় সব কিছু বাদ দিয়ে নিট মুনাফা আসে এর চেয়েও কম । এতে উৎসাহ হারায় পাটি শিল্পীরা । হস্ত ও কুটিরশিল্পকে উৎসাহিত করতে সরকারের একটি প্রতিষ্টান থাকলেও শীতল পাটির হারানো গেীরব ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যেগ চোখে পরছে না ।
নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি বিলুপ্তির পথে
মোঃ কয়েছ মিয়া :
"বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে" কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ছড়াটির নায়ক গ্রামবাংলার নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। ওসমানীনগরসহ আশপাশের পল্লী অঞ্চলে আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না । হারিয়ে যাচ্ছে এ ধরনের দেশী প্রজাতির পাখি। এদেরকে তাঁতী পাখি বা শিল্পী পাখি বলে ডাকা হয়। তবে চড়ুই পাখিদের জ্ঞাতভাই হিসেবে স্বীকৃতও রয়েছে। প্রজাতিভেদে এরা হলুদ, কালো, সাদা, বাদামি, কালো রঙেরও হয়ে থাকে। উলেখযোগ্য হচ্ছে_ কালোবুক (ব্যাক ক্রেস্টেড উইভার বার্ড), ডোরাকাটা বাবুই ও সাধারণ বাবুই। বাবুই পাখিরা শস্যদানা, বীজ, কীটপতঙ্গ খায়। গানের পাখি হিসেবেও বাবুইদের পরিচিতি রয়েছে ব্যাপক। গলার শব্দ হচ্ছে চিই-ই-ই। বাসা বানানোর সময় বাবুইরা সমস্বরে ডাক ছাড়ে। ডানা ঝাপটায় শব্দ করে। পাখির বাসা হিসেবে বাবুই পাখির বাসার উন্নত আর কোনো পাখির বাসা নেই বললে চলে। সেরা ও সুন্দর-নিপুণ বাসা হচ্ছে বাবুইদেও,শক্ত বুননি। বাসা বাঁধার কাজে এরা ধানের পাতা,সুপারি,নারিকেল ও খেজুর গাছের কচিপাতা সরু করে ঠোট দিয়ে কেটে আনে। মরা ঘাস দিয়েও বাসা তৈরী করে। তাল,নারকেল,সুপারী ইত্যাদি গাছে এদের বাসা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে সাপুড়ে ওয়ালার চমৎকার বাঁশির মতো। এতে দুটি প্রবেশপথ থাকে। ডিম-বাচ্চার কুঠরি আলাদা। সুন্দর এই ছোট পাখিরা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। ওসমানীনগর থানা এলাকাসহ বিভিন্ন পলী অঞ্চলে দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পী ও স্থপতির কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা। খড়ের বেত, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, নারিকেলে পাতা ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছ,নারিকেল বা সুপারি গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু কওে । এবং চমৎকার করে বাসা তৈরি করতে পারে বাবুই পাখিরা। তাদের বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন,তেমনি টেকসই। প্রবল ঝড়-তোপানেও টিকে থাকে তাদের বাসা। বাবুই পাখির বাসা যে কেউ টেনেও ছেঁড়াও কঠিন। বাবুই একধারে শিল্পী,স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। একটি বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরা ঘর সংসার করতে পারে ছয় সঙ্গীর সঙ্গে,তাতে স্ত্রী বাবুইয়ের না নেই। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায় বলে পলী অঞ্চলে বলা হয়ে থাকে বলে জানাযায়। কিন্তু এ ধরণের শিল্পী বাবুই বা দেশীয় পাখি রার্থে আমাদের দেশে তেমন কোনো পৃষ্টপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী পাখি । তাই এ ধরণের বাবুই পাখি রার্থে আমাদের যুগোপযোগি পদপে না নিলে এক সময় কবিতার ছন্দে পড়া ছাড়া আর খোঁজে পাওয়া যাবেনা বলে মনে করেন এলাকার পাখি প্রেমিরা।
কালের পরিক্রমায় শেরপুর ষ্টিমার ষ্টেশন এখন লঞ্চ ঘাট
মোঃ কয়েছ মিয়া :
কালের বিবর্তনে ওসমানীনগর থানার সীমান্ত এলাকার শেরপুর কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ষ্টিমার ষ্টেশন আজ লঞ্চ ও ইঞ্জিন নৌকা ঘাটে পরিনত হয়েছে। অপর দিকে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নতি সাধনের ফলে নৌপথের গুরুত্ব দিন দিন ভাটি অঞ্চলের মানুষের কছে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এতে শেরপুর লঞ্চ ঘাটের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করেছে এলাকাবাসীর কাছে। নদীপথে যাতায়তকারীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঘাটের বিভিন্ন অসাধু মানুষ কতর্ৃক প্রতিনিয়ত যাত্রী সাধারণকে হয়রানীর অভিযোগও পাওয়া গেছে । নদী সংস্কারে সরকারের সদইচ্ছার অভাব ইজারাদারদের যাএী নির্যাতনের ফলে কালের গর্ভে বিলিন হতে চলছে এই ঐতিহ্যবাহী ঘাট। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,আজ থেকে প্রায় দুই শত বছর পূর্ব থেকে বালাগঞ্জ বর্তমান ওসমানীনগর ও মৌলভীবাজার এলাকার শেরপুরে একটি ষ্টিমার ষ্টেশন ছিল। অনেক বড় বড় পন্য বাহী ষ্টিমার কলকাতা থেকে ফেঞ্জুগঞ্জে যাতায়ত করত। ব্যবসায়ীরা ষ্টিমার যোগে কলকাতা থেকে মালামাল আনা নেওযা করতেন। এবং ষ্টিমারগুলো এসে শেশরপুরে এসে নোঙ্গর করত । এসময় শেরপুর ষ্টিমার ষ্টেশন তৎকালীন আসাম প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সময়ের ব্যবধানে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদীর বিধ্বংসী নদী ভাঙ্গন ক্রিয়ায় পাল্টে গেছে নদীর ভৌগলিক গতি পথ । ভরাট্ হয়ে যাচ্ছে গভীর তল দেশ। এ কারণে কালের পরিক্রমায় কুশিয়ারা নদী দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় ষ্টিমার চলাচল। আর শেরপুর হারায় আন্তর্জাতিক ষ্টিমার ষ্টেশনের মর্যাদা। এরকম আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য যদি আস্তে আস্তে আমার মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বচ েনা দেখে শুধু বইয়ের পাতা বা ইতিহাসের পাতায় খোঁজা ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা । তাই অভিজ্ঞরা মনে করেন নৌপথকে সার্বিকভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসলে এক দিকে যেমর যানঝট কমবে আর অন্য দিকে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে । তাই সরকার এই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনলে কিছুটা নাহয় বেকারত্ব হ্রাস পাবে ।
এই ঘাট দিয়ে কিশোরগঞ্জ,ভৈরব,ঢাকা,সুনামগঞ্জের দিরাই,শাল্লা,জগন্নাথপুর,হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ,নবীগঞ্জ,বানীয়াচং ও সিলেটের বালাগঞ্জ,ওসমানীনগর থানার অধিকাংশ মানুষ নৌ পথে যাতায়ত করতো । কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে আশির দশকের মাঝা মাঝি সময়ে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নতি লাভ । তাই মানুষ এ অঞ্চলের নৌপথে চলাচল না করে স্বল্প সময়ে সড়ক পথে যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দবোধ করতে শুরু করেন। একসময় মানুষের কাছ থেকে হারায় ষ্টিমার,লঞ্চ এর জনপ্রিয়তা। এঘাটটি পূর্বে ওসমানীগর থানার আরঙ্গপুর নামক স্থানে ছিল। আরঙ্গপুর এলাকায় ঘাট ইজরাদার কর্তৃক যাত্রীদের হয়রানীর অভিযোগের ভিত্তিতে নৌ পরিবহন কর্তৃপ ১৯৯৩ সালে মৌলভীবাজার সদর থানার শেষপ্রান্ত এবং ওসমানীনগর থানার সীমান্ত এলাকায় ঐতিহ্যবাহী শেরপুর লঞ্চ ঘাটের অনুমোদন করে। সে থেকে শেরপুর লঞ্চঘাট সরকারকে ইজারা দিয়ে আসছে। আরঙ্গপুরের মতো শেরপুর লঞ্চ ঘাটেও মাত্রাতিরিক্ত টোল আদায় করা হয়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সচেতন মহল মনে করেন সরকার যথাযথ নদী সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহন করে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থায় রতি হবে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদী তথা ষ্টিমার স্টেশন। আর পুনঃরুজীবত হবে শেরপুর লঞ্চ ও ষ্টিমার ষ্টেশন।
মো:কয়েছ মিয়া :
আবহমান বাংলার লোকশিল্পের এক ঐতিহ্যর নাম শীতলপাটী । অনেক লোক ,গানে,কবিতায় নানাভাবে উচ্ছারিত হয়েছে শীতলপাটির কথা । গ্রামবাংলায় কারো বাড়ীতে নতুন অতিথি এলে শীতল পাটি বিছিয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য বহুকালের । সেই ঐতিহ্যর কথা এখন শোনা যায় লোক ছড়ার কাহিনিতে । শীতল পাটির ছোয়ায় প্রাণ জোরাতো আগেকার মানুষের । বর্তমানে শীতল পাটি শিল্পীদের জীবন একেবারেই নাজুক । জীবন এবং জীবিকার তাগিদে অনেকে বদল করেছেন এ পেশা । শীতল পাটি এক সময় এ অঞ্চলে সভ্যতার মাপকাঠি ছিল । কিন্তুু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শীতল পাটি শিল্প বাজারে প্রচন্ড মার খেতে থাকে । ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলেও শীতল পাটির কদর কম ছিলনা । পরম কাংখিত অতিথি এলে শীতল পাটিতে বসতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।বালাগঞ্জ,ওসমানীনগরেরতেঘরিয়া,আতাসন,চাঁনপুর,শ্রীনাথপুর,গৌরীপুর,মহিষাশি,বিলবাড়ি,লোহামোড়া,ঝুগিপুর,কামারগাঁও,খালিশপুর প্রভৃতি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক লোক শীতল পাটি শীল্পের সাথে জড়িত ছিল । কিন্তুু শ্রম ও বাজারমূল্যের প্রচন্ড ব্যবধান এ শিল্পীদেরকে বিমুখ করে তুলেছে । মুতর্া নামক সরু গাছ ৮থেকে ১০দিন পানিতে ডুবিয়ে রেখে রোদ্রে শুকানো হয়। এর পর মুর্তা গাছের ছাল থেকে হালকা বেত তৈরী করা হয় । তারপর বেতগুলো বিভিন্ন প্রকার রঙে রাঙ্গিয়ে শিল্পী তার দ হাতে বুনন করে একের পর এক শীতল পাটি। ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের মতো শীতল পাটিও ছিল সৌন্দযর্্য ও শীল্পের প্রতীক । ব্রিটিশ আমলে লন্ডরের রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রাসাধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল । সে এক কালের কথা ,পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বেড়াতে আসতো বণিকরা বালাগঞ্জ,ওসমানীনগরে । সেখানে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে তারা নিয়ে যেত বাহারি শীতল পাটি। ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,রাশিয়ায় শীতল পাটির কদরও ছিল ঈর্ষণীয়। ভারতবর্ষ আগমনে প্রমাণ হিসাবে ভিন দেশীরা ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি বালাগঞ্জের,ওসমানীনগরের শীতলপাটি নিয়ে যেত স্মৃতি হিসাবে । ১৯৯১সালে বিশ্বের কারুশিল্পের একটি প্রদর্শনী ইতালির রোমে অনুষ্টিত হয়ে ছিল । বিলবাড়ী গ্রামের মহিন্দ্র নাথ এদেশীয় প্রতিনিধি হিসাবে শীতল পাটি নিয়ে অংশ গ্রহন করেন । শীতলপাটির বুনন শৈলী অন্যান্য শিল্পীদের প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৮২সালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসাবে স্বীকৃতী পান তেঘরিয়ার পবন জয় দাস । শীতলপাটি হরেক রকম হয়ে থাকে এদের মধ্যে পয়সা,শাপলা,সোনামুড়ি,জয়পাটি,টিক্কা,সিকি,লালগালিচা,আধুলি,মিহি প্রভৃতির কদর ছিল বেশি। কথিত আছে এমন ভাবে মিহি ও পিচ্ছিল ভাবে তৈরী করা হতো যে একটা সাপ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারতোনা । শীতলপাটি শিল্পীরা হিন্দু সমপ্রদায় ভুক্ত । আর পাটিতে তারা নানা ধরনের মন্দিরা,ত্রিশুল ও আলপনার আদল তৈরী করত । হালের তাজ মহলও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি । শীতল পাটি শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা জানতে কথা হয় সোনামনি দাসের সাথে। তিনি বলেন একটা শীতল পাটি তৈরি করতে ১০থেকে১৫দিন লাগে । কিন্তুু বাজারে সাধারণ শীতল পাটি বিক্রি করলে ৩০০-৪০০টাকার বেশি মুল্যে পাওয়া যায় না আর সু বেতের তৈরী শীতল পাটি প্রায় ১০ থেকে ১৫হাজার টাকা বিক্রি হয়। ফলে শ্রমমুল্যে না পাওয়ায় অনেকেই এখন আর শীতল পাটি তৈরি করতে আগ্রহী নন । যার জন্য দিন দিন লোকের ঘর থেকে সরে গিয়ে শুভা পাচ্ছে ইতিহাসের পাতায় । এমন দিন ছিল বিভিন্ন খাল বিল ও লোকালয়ের পাশে শীতল পাটির প্রধান উপকরণ মুর্তা পাওয়া যেত । কিন্তুু বর্তমানে তা দুষপ্রাপ্য হয়ে উঠেছে । লোকজন নিজেদের প্রয়োজনে মুর্তা উজার করে ফেলতেছে । দরিদ্র অনেক পরিবার তাদের বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করে থাকেন । আশি সালের দিকে একবার সরকার মুর্তা উৎপাদনের জন্য ঋণ দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে আর কোন উদ্যেগ গ্রহন করা হয়নি । ফলে মুর্তা এখন নেই বললেই চলে । দূর থেকে মুর্তা ক্রয় করে আনতে যে খরছ হয় সব কিছু বাদ দিয়ে নিট মুনাফা আসে এর চেয়েও কম । এতে উৎসাহ হারায় পাটি শিল্পীরা । হস্ত ও কুটিরশিল্পকে উৎসাহিত করতে সরকারের একটি প্রতিষ্টান থাকলেও শীতল পাটির হারানো গেীরব ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যেগ চোখে পরছে না ।
নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি বিলুপ্তির পথে
মোঃ কয়েছ মিয়া :
"বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে" কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ছড়াটির নায়ক গ্রামবাংলার নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। ওসমানীনগরসহ আশপাশের পল্লী অঞ্চলে আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না । হারিয়ে যাচ্ছে এ ধরনের দেশী প্রজাতির পাখি। এদেরকে তাঁতী পাখি বা শিল্পী পাখি বলে ডাকা হয়। তবে চড়ুই পাখিদের জ্ঞাতভাই হিসেবে স্বীকৃতও রয়েছে। প্রজাতিভেদে এরা হলুদ, কালো, সাদা, বাদামি, কালো রঙেরও হয়ে থাকে। উলেখযোগ্য হচ্ছে_ কালোবুক (ব্যাক ক্রেস্টেড উইভার বার্ড), ডোরাকাটা বাবুই ও সাধারণ বাবুই। বাবুই পাখিরা শস্যদানা, বীজ, কীটপতঙ্গ খায়। গানের পাখি হিসেবেও বাবুইদের পরিচিতি রয়েছে ব্যাপক। গলার শব্দ হচ্ছে চিই-ই-ই। বাসা বানানোর সময় বাবুইরা সমস্বরে ডাক ছাড়ে। ডানা ঝাপটায় শব্দ করে। পাখির বাসা হিসেবে বাবুই পাখির বাসার উন্নত আর কোনো পাখির বাসা নেই বললে চলে। সেরা ও সুন্দর-নিপুণ বাসা হচ্ছে বাবুইদেও,শক্ত বুননি। বাসা বাঁধার কাজে এরা ধানের পাতা,সুপারি,নারিকেল ও খেজুর গাছের কচিপাতা সরু করে ঠোট দিয়ে কেটে আনে। মরা ঘাস দিয়েও বাসা তৈরী করে। তাল,নারকেল,সুপারী ইত্যাদি গাছে এদের বাসা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে সাপুড়ে ওয়ালার চমৎকার বাঁশির মতো। এতে দুটি প্রবেশপথ থাকে। ডিম-বাচ্চার কুঠরি আলাদা। সুন্দর এই ছোট পাখিরা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। ওসমানীনগর থানা এলাকাসহ বিভিন্ন পলী অঞ্চলে দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পী ও স্থপতির কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা। খড়ের বেত, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, নারিকেলে পাতা ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছ,নারিকেল বা সুপারি গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু কওে । এবং চমৎকার করে বাসা তৈরি করতে পারে বাবুই পাখিরা। তাদের বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন,তেমনি টেকসই। প্রবল ঝড়-তোপানেও টিকে থাকে তাদের বাসা। বাবুই পাখির বাসা যে কেউ টেনেও ছেঁড়াও কঠিন। বাবুই একধারে শিল্পী,স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। একটি বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরা ঘর সংসার করতে পারে ছয় সঙ্গীর সঙ্গে,তাতে স্ত্রী বাবুইয়ের না নেই। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায় বলে পলী অঞ্চলে বলা হয়ে থাকে বলে জানাযায়। কিন্তু এ ধরণের শিল্পী বাবুই বা দেশীয় পাখি রার্থে আমাদের দেশে তেমন কোনো পৃষ্টপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী পাখি । তাই এ ধরণের বাবুই পাখি রার্থে আমাদের যুগোপযোগি পদপে না নিলে এক সময় কবিতার ছন্দে পড়া ছাড়া আর খোঁজে পাওয়া যাবেনা বলে মনে করেন এলাকার পাখি প্রেমিরা।
কালের পরিক্রমায় শেরপুর ষ্টিমার ষ্টেশন এখন লঞ্চ ঘাট
মোঃ কয়েছ মিয়া :
কালের বিবর্তনে ওসমানীনগর থানার সীমান্ত এলাকার শেরপুর কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ষ্টিমার ষ্টেশন আজ লঞ্চ ও ইঞ্জিন নৌকা ঘাটে পরিনত হয়েছে। অপর দিকে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নতি সাধনের ফলে নৌপথের গুরুত্ব দিন দিন ভাটি অঞ্চলের মানুষের কছে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এতে শেরপুর লঞ্চ ঘাটের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করেছে এলাকাবাসীর কাছে। নদীপথে যাতায়তকারীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঘাটের বিভিন্ন অসাধু মানুষ কতর্ৃক প্রতিনিয়ত যাত্রী সাধারণকে হয়রানীর অভিযোগও পাওয়া গেছে । নদী সংস্কারে সরকারের সদইচ্ছার অভাব ইজারাদারদের যাএী নির্যাতনের ফলে কালের গর্ভে বিলিন হতে চলছে এই ঐতিহ্যবাহী ঘাট। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,আজ থেকে প্রায় দুই শত বছর পূর্ব থেকে বালাগঞ্জ বর্তমান ওসমানীনগর ও মৌলভীবাজার এলাকার শেরপুরে একটি ষ্টিমার ষ্টেশন ছিল। অনেক বড় বড় পন্য বাহী ষ্টিমার কলকাতা থেকে ফেঞ্জুগঞ্জে যাতায়ত করত। ব্যবসায়ীরা ষ্টিমার যোগে কলকাতা থেকে মালামাল আনা নেওযা করতেন। এবং ষ্টিমারগুলো এসে শেশরপুরে এসে নোঙ্গর করত । এসময় শেরপুর ষ্টিমার ষ্টেশন তৎকালীন আসাম প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সময়ের ব্যবধানে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদীর বিধ্বংসী নদী ভাঙ্গন ক্রিয়ায় পাল্টে গেছে নদীর ভৌগলিক গতি পথ । ভরাট্ হয়ে যাচ্ছে গভীর তল দেশ। এ কারণে কালের পরিক্রমায় কুশিয়ারা নদী দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় ষ্টিমার চলাচল। আর শেরপুর হারায় আন্তর্জাতিক ষ্টিমার ষ্টেশনের মর্যাদা। এরকম আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য যদি আস্তে আস্তে আমার মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বচ েনা দেখে শুধু বইয়ের পাতা বা ইতিহাসের পাতায় খোঁজা ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা । তাই অভিজ্ঞরা মনে করেন নৌপথকে সার্বিকভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসলে এক দিকে যেমর যানঝট কমবে আর অন্য দিকে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে । তাই সরকার এই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনলে কিছুটা নাহয় বেকারত্ব হ্রাস পাবে ।
এই ঘাট দিয়ে কিশোরগঞ্জ,ভৈরব,ঢাকা,সুনামগঞ্জের দিরাই,শাল্লা,জগন্নাথপুর,হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ,নবীগঞ্জ,বানীয়াচং ও সিলেটের বালাগঞ্জ,ওসমানীনগর থানার অধিকাংশ মানুষ নৌ পথে যাতায়ত করতো । কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে আশির দশকের মাঝা মাঝি সময়ে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নতি লাভ । তাই মানুষ এ অঞ্চলের নৌপথে চলাচল না করে স্বল্প সময়ে সড়ক পথে যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দবোধ করতে শুরু করেন। একসময় মানুষের কাছ থেকে হারায় ষ্টিমার,লঞ্চ এর জনপ্রিয়তা। এঘাটটি পূর্বে ওসমানীগর থানার আরঙ্গপুর নামক স্থানে ছিল। আরঙ্গপুর এলাকায় ঘাট ইজরাদার কর্তৃক যাত্রীদের হয়রানীর অভিযোগের ভিত্তিতে নৌ পরিবহন কর্তৃপ ১৯৯৩ সালে মৌলভীবাজার সদর থানার শেষপ্রান্ত এবং ওসমানীনগর থানার সীমান্ত এলাকায় ঐতিহ্যবাহী শেরপুর লঞ্চ ঘাটের অনুমোদন করে। সে থেকে শেরপুর লঞ্চঘাট সরকারকে ইজারা দিয়ে আসছে। আরঙ্গপুরের মতো শেরপুর লঞ্চ ঘাটেও মাত্রাতিরিক্ত টোল আদায় করা হয়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সচেতন মহল মনে করেন সরকার যথাযথ নদী সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহন করে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থায় রতি হবে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদী তথা ষ্টিমার স্টেশন। আর পুনঃরুজীবত হবে শেরপুর লঞ্চ ও ষ্টিমার ষ্টেশন।