উজ্জ্বল দাশ : চট্রগ্রামের চন্দ্রনাথ ধামের সীতাকুন্ড নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও
ধর্মশাস্ত্র্রে্র সীতা কুন্ডের যে বর্ননা পাওয়া যায় তা হলো-সত্যযুগে দক্ষরাজ
একটি যজ্ঞানুষ্ঠানের আযোজন করেন। উক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে দক্ষ দেবাদিদেব
মহাদেবকে আমন্ত্রন
করেননি। দক্ষরাজ কতৃক শিবকে
অবজ্ঞার হেতু অপমান বোধ করেন মহাদেব পত্নী সতীদেবী। রাগে-ক্ষোভে-অপমানে তিনি দেহ ত্যাগ করেন। পত্নী বিয়োগে মহাদেব
উন্মত্ত হয়ে উঠেন। সতীদেবীর মৃত দেহ
কাঁধে নিয়ে তিনি শুরু করেন নিত্য। এ প্রলয় নাচনে শংকিত হন সৃষ্ঠির পালনকর্তা বিষ্ণুদেব। সৃষ্টি রক্ষার্থে
তিনি সুদর্শন চক্রের সাহায্যে মহাদেবের কাঁধের সতীদেবীর দেহটিকে একান্ন খন্ডে ভাগ
করে নিক্ষেপ করেন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। যে একান্ন স্থানে সতীর দেহের অংশ পড়ে সেস্থানই একান্ন পীঠ
হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ডনকৃত সতীর ডান হাত পড়ে চট্রগ্রামের সীতাকুন্ডের
চন্দ্রনাথ ধামে। গবেষকদের মতে সতীর
স্মৃতি বিড়জিত চট্রগ্রামের চন্দ্রনাথ ধামের নাম প্রথমে ছিল সতীকুন্ড কালের
বিবর্তনে তা সীতাকুন্ড হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী(শিব চতুর্দশী) তিথিতে
মানুষের মেলা বসে চট্রগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সীতা কুন্ড
পাহাড়ে। ৩৫০ কিলোমিটারের এক
বিশাল অংশের পাহাড় এলাকা ঘিরেই আবর্তিত এ তীর্থক্ষেত্র। এ অংশের মনোরম প্রাকৃতিক দূশ্য সত্যিই
মনোমুগ্ধকর। পাশাপাশি এখানে দু
পাহাড়ের শীর্ষস্থানে আছে দুটি মন্দিরের অবস্থান। একটি বিরুপাক্ষ মন্দির অন্যটি চন্দ্রনাথ মন্দির। চন্দ্রনাথ মন্দিরটি
সমতল ভূমি থেকে ১৩০০ ফুট উচ্চে পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থিত। এ মন্দির তথা পাহাড় একে অন্যে মিলেমিশে এশাকার
হয়ে চন্দ্রনাথ ধাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে ।প্রতি বছরের মতো এবারো গত ১২ই ফেব্রায়ারী শ্রী
শ্রী শিব রাত্রি ব্রত উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধান তীর্থ স্থান বলে খ্যাত চন্দ্রনাথ
ধামে বসে ছিল মানুষের মিলন মেলা। দেশ-বিদেশের অগনিত ভক্তবৃন্দের আগমনে সাজ সাজ রব পড়েছিল
পুরো এলাকা জুড়ে।
তীর্থস্থান
পবিত্র স্থান। তীর্থের জল, মাটি বাতাস সবই
পবিত্র। আর তাইতো তীর্থ
স্থানে গেলে মন পবিত্র হয়। মনে ধর্ম ভাব জাগে। ধর্মভাব জাগরনে মনের কলুষতা দুর হয়। পাপ কাজ থেকে মনকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়। তীর্থস্থান মানুষের
মিলন মেলার স্থান। সেখানে গেলে কোন
হিংসা-বিদ্বেষ, উচু নীচু ভেদ বেষম্য কিংবা জাগতিক লোকসানের চিন্তাবোধ থাকেনা। তীর্থস্থান ভ্রমনের ফলে মনের ময়লা কাটে,পূন্য আসে,মন জুড়ায়,অশান্তি দুর হয়।তাইতো কবি বলেছেন- ‘‘তীর্থের মহিমা না করা যায় বর্নন, করিলে ভ্রমন হয় মনের
পবিত্রতায় পূন্য সঞ্চালন’’।
সীতা মন্দির
নামে পাহাড়ের পাদদেশে আছে একটি মন্দির। এ মন্দিরটির অবস্থান আকর্ষনীয়। ধর্মীয় গাম্ভীর্যের ভাব আর প্রকৃতির নির্ঝরনী
শব্দ দুয়ে মিলে মনোরম দূশ্য মুগ্ধ করে আগন্তুক ভক্তদের। উক্ত মন্দির অভ্যন্তরে আছে চতুর্ভূজা সীতাদেবীর
মূর্তি। ত্রিপুরার ইতিহাসের
তথ্যানুযায়ী সম্ভুনাথ মন্দিরের প্রথম কাজ হয়েছিল ১৫০১ খ্রিষ্ঠাব্দে । ১৯২০/১৯২৪ সালে এ
মন্দিরটি সংস্কার করেন ত্রিপুরার মহারানী রত্নমঞ্জরী। এ ছাড়াও মধ্যবর্তী পাহাড়ে আছে আরও বেশ
কয়েকটি মন্দির। স্বয়ম্ভুনাথ, রামকুন্ড, লক্ষনকুন্ড মন্দিরের
নাম বিশেষভাবে উল্যেখযোগ্য। উল্লেখিত মন্দির গুলোর মধ্যে এই তিথিতে ভক্ত সমাগম ও
পুজার্চনা হয় সম্ভুনাথ মন্দিরে। কেননা সুউচ্চ পাহাড়ে যাদের পক্ষে উঠা সম্ভব হয়না তারাই এ
মন্দিরে পুজার্চনা করেন। সম্ভুনাথ মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দিতে ধনমানিক্য বাহাদুর, পরৈকোড়ার জমিদার
বৃন্দাবন দেওয়ানের মাতা দুগৃা রানী, প্রতাপ চৌধুরী ও মুক্তাগাছার জমিদার বিদ্যাময়ী
দেবীর অর্থায়নে নির্মিত। ১৯২৩ সালে বর্ধমান জেলার শিয়ালশোলের রাজা শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ মালিয়া
শম্ভুনাথ মন্দিরে যাওয়ার ৬৮টি সিড়ি নির্মান করে দেন। চন্দ্রনাথ পাদদেশ থেকে শীর্ষস্থান পর্যন্ত থাক
থাক করে বানানো হয়েছে সিঁড়িঁ। সিঁড়িঁগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন বানিয়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ uঁসড়িঁর গায়ে খোদিত
আছে উদ্যোক্তার নাম। পাপ খন্ডন অথবা নিকট আত্নীয়দের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে সিঁড়িগুলো। প্রাপ্ত তথ্য থেকে
জানা যায়,সিঁড়িঁ নির্মানের প্রথম উদ্যোগ গ্রহন করেন চবিবশ পরগনা নিবাসী শ্রী গঙ্গারাম
বিশ্বাস। তার বৃদ্ধ মাতা
চন্দ্রনাথ দর্শনে এসে পাহাড়ী দূর্গমপথে পৌছুতে পারেননি চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এ কারনে বৃদ্ধমাতা
ছেলেকে নির্দেশ দেন- সীতাকুন্ড পাহাড়ে সিঁড়ি নির্মান করে দেওয়ার। মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে
১২৭০ বঙ্গাব্দে শ্রী গঙ্গারাম বিশ্বাস সীতাকুন্ডের পাহাড়ী পথে ৭৮২টি সিঁড়িঁ
নির্মান করেন। নানা কারনে সিঁড়িঁ
গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে ১৩২৯ বঙ্গাব্দে সিঁড়িঁ গুলো সংস্কার করে দেন চবিবশ পরগনার
জমিদার শ্রী সূর্যকান্ত রায় চৌধুরী। এরপর শ্রী গোপাল চন্দ্র সাহা ও মধুসূধন সাহা নামের দুই
সহোদর বিরুপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত প্রায় ১.২৫ কিলোমিটারের
পথে সিঁড়িঁ নিমান করে দেন। এছাড়াও অন্নদা রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় ও বসন্ত কুমারী দেবীর
নামে রয়েছে কিছু সিঁড়িঁ। এ সিঁড়িঁ গুলো নির্মানের ফলে তীর্থযাত্রীরা পৌছাতে পারেন
শীর্ষস্থানে।
মূল পাহাড়ী
চুঁড়ায় অবস্থিত মন্দিরটি চন্দ্রনাথ মন্দির এবং সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গে অবস্থিত
বিরুপাক্ষ মন্দির। পরৈকোড়ার জমিদার
নারায়ন লালা এ মন্দিরগুলোর নির্মাতা। তিনি চন্দ্রনাথ মন্দির ও বিরুপাক্ষ মন্দিরের জল সরবরাহের
খরছ নির্বাহে ৮০০দ্রোন লাখেরাজ ভূমি দান করেছিলেন। ১৩২৫ সালে মন্দির গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে রংপুরের
ডিমলার রানী শ্রীমতী বৃন্দা রানী চৌধুরানী বহু অর্থ ব্যায় করে মন্দির গুলোর সংস্কার করে দেন । এ ছাড়াও তিনি ১৩০৪ বঙ্গাব্দে
চন্দ্রনাথ ও বিরুপাক্ষ মন্দিরের সিঁড়িঁ ও লৌহ সেতু নির্মান করে দেন এবং তাহার
স্বামী রাজা শ্রী জানকি বল্লভ সেনের নামে স্মৃতি ফলক দেন। মন্দির নির্মান,সংস্কার ও উন্নয়নে আরও অনেক ব্যাক্তির অবদান
রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরার
রাজা শ্রী গোবিন্দ মানিক্য,সরোয়াতলী গ্রামের জমিদার শ্রী রাম সুন্দর সেন এবং
ময়মনসিংহের জমিদার রাজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী অন্যতম।
বর্তমানে
মন্দির গুলো হারিয়েছে পূর্বশ্রী। মন্দিরের প্রতিটি ইট,বালু,পাথর যেনো আগন্তুকদের কাছে জানতে চায় বর্তমান
সনাতনধর্মাল্বীদের সমাজে কি উদার ব্যাক্তিদের অভাব! তারা বলে দিতে চায় সমাজের
বিত্তবানদের জানিয়ে দিও আমরা আর পারছিনা সংস্কার করা জরুরী।