তানজিনা হোসেন :: বিমানের
জানালা দিয়ে যে আকাশ দেখা যায়, তা
প্রতিদিনের চেনা আকাশ নয়। এই আকাশ ধোঁয়াটে, কুহেলিকাময়। জানালার
শাটার নামিয়ে দেন তিনি। হাঁটু দুটো টনটন করছে। আরও
কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে কে জানে? এয়ারপোর্টে
বিদায় দিতে এসে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল জুঁইমা, ছুটিটা
পেয়েই আমি প্লেনে উঠব। তুমি একা যেতে পারবে তো? একা?
হ্যাঁ, একাই তো। সত্যি
একা হয়ে গেলেন বনলতা। প্রথম দিনটির কথা আজ খুব বেশি
মনে পড়ছে। কত দিন আগের কথা। আজকাল
ধূসর হয়ে এসেছে স্মৃতিগুলো। তার পরও মনের আকাশে স্পষ্ট সেই
অস্থির চঞ্চল মুখটা—তুমি নাকি
গান জানো? ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে তোমাকে গান গাইতে
হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। মফস্বলের
স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া এক কথা, আর
বিশ্ববিদ্যালয়ে এত এত মানুষের সামনে স্টেজে ওঠা? অসম্ভব!
কাঁচুমাচু মুখ দেখে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, সেকি? কথা বলছ না কেন? আমি নাম লিখে নিচ্ছি। কী
যেন নাম, বলো তো? —ইয়ে, নাম? মানে আমার নাম? বনলতা
চৌধুরী। মুহূর্তে রাজ্যির ব্যস্ততা আর অস্থিরতা থেমে
গেল। কলমটা কাগজের ওপর আটকে রইল কিছুক্ষণ। আর
কৌতুক মেশানো চোখ দুটো তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া মুখের ওপর। তারপরই
হা হা উদাত্ত হাসি—বনলতা
চৌধুরী? সেন নয়? কী
সর্বনাশ! সর্বনাশের কী আছে বোঝেনি সে। কিন্তু ভেতর
ভেতর ঠিকই সর্বনাশের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছিল। সে
কি তা বুঝতে পেরেছিল?এর অনেক দিন
পরে, একদিন সে সেই কথা তুলেছিল। হাসতে
হাসতে বলেছিলে, প্রথম দিন তোমার নামটা শুনেই কেমন বুকে দোলা
লেগেছিল আমার, জানো? তুমি
বুঝতে পারোনি।
আগে কখনো স্বীকার করিনি, নিজেকেই
যেন বলেন, বনলতা, আজ
করছি। আমারও লেগেছিল অমন দোলা। তোমার
প্রাণখোলা হাসি শুনে। শুধু ওই দিনই কেন, এরপর কত কত দিন, কত কত বার, কত
কিছু একই রকমভাবে অনুভব করেছি আমরা। একই গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি, একই কবিতায় বুঁদ হয়েছি। একই
কান্না কেঁদেছি। একই আনন্দ, একই
শিহরণ, একই উচ্ছ্বাস, একই
বেদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। তবে আজ কেন
ঈশ্বর আমায় একাকী এই বেদনার সম্মুখীন করবেন?
বিমানবালা এসে খাবার দিতে চাইলে হাত তুলে নিষেধ করলেন তিনি। হূদয়টা
কেন যেন অভিমানে ফুঁসে উঠছে বারবার। চোখের সামনে ছোট্ট স্ক্রিনে
একের পর এক ফেলে আসা দৃশ্যগুলোই দেখতে পাচ্ছেন যেন। কলেজে
নিত্য লেগে থাকত অশান্তি, কোন্দল। এই
কমিটি, সেই কমিটি। ক্লাস
শেষে টিউশনি করতে বেরোতে তুমি। ফিরতে অনেক রাতে। তবু
কি সংসার চলে? বাদলের টাইফয়েড, শিশু হাসপাতালে ওকে নিয়ে এক মাস। এক
রাতে ডাক্তার জবাব দিয়ে গেল। হাসপাতালের বারান্দায়
দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছিলে, আমি দেখে
ফেলেছিলাম। আরেকবার জুঁই গরম পানিতে পা পুড়িয়ে ফেলল। সেলফোনের
যুগ তো নয় যে জানাব। কাঁদতে কাঁদতে ওকে নিয়ে ঢাকা
মেডিকেলে ছুটলাম। তুমি খুঁজতে খুঁজতে অনেক রাতে এলে উদ্ভ্রান্ত
চেহারায়। কই, তখন
সেই দাঁত চেপে ঘাড় গুঁজে মেনে নেওয়ার দিনগুলোতে, নুন
আনতে পান্তা ফুরোনোর গ্লানিটুকু পার করার সময় কখনো এত একা লাগেনি তো। অথচ
এখন সবকিছু আছে—অর্থকড়ি, সম্মান, সন্তানের
সাফল্যে উদ্ভাস, ফেলে-ছড়িয়ে
খরচ করার মতো সামর্থ্য—তবু
হাহাকারে ভরে আছে হূদয়। বলো দেখি, জুঁই আর বাদল কি কখনো বুঝবে, কী দিন পার করেছি আমরা? বনলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
একবার আমরা কক্সবাজার গেলাম। সমুদ্র
দেখে বাদলের সেকি দাপাদাপি! আর মেয়েটা রইল ভয়ে সিঁটিয়ে—পানিতে নামবে না। কিছুতেই
না। তুমি ওকে জোর করে নামালে। জুঁইয়ের
ফ্লোরিডার বিশাল বাড়িটার একেবারেই কাছে সমুদ্র। জুঁই
এখনো পানিতে নামতে ভয় পায়। ওর মেয়েটাও। বাদল
বুয়েটে চান্স না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। দিন-রাত
বাইরে ঘুরে বেড়াত। সিগারেট ধরেছিল, দাড়ি রেখেছিল। চিন্তায়
চিন্তায় আমি অর্ধেক। তুমি ভাবতেও পারবে না বাদল এখন
কত বড় চাকরি করে মেলবোর্নে। ওর প্রাসাদোপম বাড়ি, ফেরারে গাড়ি আর শানশওকত দেখে আমি হতভম্ব। আহা, তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম। ভালো
কি মন্দ কোনো কিছুই আমি যে কখনো তোমাকে ছাড়া উপভোগ করিনি। এই
প্রথম। আর এই শেষ।
মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের সংসারে দুটি ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে, বাড়িতে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে, গরিব আত্মীয়স্বজনকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে
আর যথাবিহিত সম্মানপূর্বক উৎসব-আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যে যৎসামান্য সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা কেনা
হয়েছিল। ছেলেমেয়ের প্রাসাদের তুলনায় সেটা নিতান্তই
কুঁড়েঘর। তবু এই কুঁড়েঘরেই আমরা বেশ অবসর জীবনযাপন
করছিলাম। ভেবেছিলাম, এখন
আবার তুমি আমি আগের মতো বই পড়ে, গান শুনে, নাটক দেখে আর গল্পগাছা করে বাকি জীবনটা এবার
পার করে দেব। কিন্তু তোমার সারা হলেও আমার হলো শুরু। বউমা
অন্তঃসত্ত্বা, বাদল ফোন করে অনুনয় করে, মা তুমি একটু আসো। বাবুর
ছয় মাস হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে কিন্তু। জুঁই
লাইসেন্স পরীক্ষা দেবে, ওর দুই
বছরের মেয়েটাকে দেখবে কে? মাগো, তুমি না এলে আমার পরীক্ষাই দেওয়া হবে না। আমি
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগলাম। আর
এখানে রইলে তুমি। স্কাইপে দেখা হতো তোমার সঙ্গে, ফোনে কথা হয় রোজই। কিন্তু
এক সমুদ্র দূরত্ব দুজনের মধ্যে। সেই দূরত্ব তুমি আরও বাড়িয়ে
দিলে?
বিমান এবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে
যাচ্ছে। যাত্রীদের চোখে-মুখে স্বস্তি আর আনন্দ। সবাই
প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাচ্ছে। বনলতা মুখ নিচু করে চোখ মুছলেন। তাঁকে
যেতে হবে বারডেমের হিমঘরে, যেখানে
অপেক্ষা করে আছে তাঁর একজীবনের ভালোবাসার শেষ প্রহরটি। আজ
নিজ হাতে যবনিকা টানবেন সেই প্রেমের গল্পের।