Wednesday 18 July 2012

বিষাক্ত ফরমালিনযুক্ত মাছ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব


সিতু সূত্রধর :: বাজারে ফরমালিনযুক্ত মাছ বিক্রি হচ্ছে এমন খবর বেশকিছুকাল থেকে গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত রুই জাতীয় মাছ এবং দেশীয় ছোট মাছ যেমন : কাচকি, মলা, পাবদা, সরপুঁটি ইত্যাদি মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তাই ফরমালিন নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে মাছ ক্রয়ের সময় ফরমালিনযুক্ত মাছ চেনার উপায় কী?

 কতমাত্রায় ফরমালিন থাকলে মানবদেহের জন্য তা ক্ষতিকর এবং কী কী মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে।
ফরমালিনের পরিচিতি : বর্ণহীন ফরমালডিহাইড গ্যাসের দ্রবণকেই ফরমালিন বলা হয়। বাজারজাতকৃত ফরমালিনে ৩৭-৪০% ফরমালডিহাইড থাকে, বাকিটা পানি এবং মিথানল। ফরমালিন বাজারে পরমল নামেও বিক্রি হয়ে থাকে। ফরমালিন অতিমাত্রায় বিষাক্ত একটি জৈবযৌগ পদার্থ এবং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিভিন্ন জৈবপদার্থ সংরক্ষণে সাধারণত ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। মাছকে বাজারে দীর্ঘক্ষণ সজীব রাখার উদ্দেশে অসাধু বিক্রেতারা ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে।
কোথায় কোথায় মাছে ফরমালিন মিশানো হয় : আমাদের দেশে রুই-কাতলা জাতীয় মাছ মূলত পার্শ্ববর্তী একটি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। ওই দেশে মাছধরা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বাজারজাত করতে ৪/৫ দিন সময় লাগে। আমদানিকারিদের ধারণা, বিদেশে মাছে কোন ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না। দেশের অভ্যন্তরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাছে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই দেশ থেকে আমদানিকৃত রুই জাতীয় মাছ পরিবহনে নৌকা/ট্রলার এবং বিভিন্ন অবতরণ কেন্দ্র থেকে সংগৃহিত মাছে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকালে দেখা যায়, পরিবহন নৌকা/ট্রলারে মাছের স্তূপের বিভিন্ন স্তরে এমনভাবে বরফকুচি ব্যবহার করা হয় যাতে ৩/৪ দিনে মাছে কোনরূপ পঁচন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। টেকনাফে মৎস্য অবতরণকেন্দ্র থেকে সংগৃহীত মাছেও ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এতে প্রতীয়মান হয়, দেশে বাজারজাত করার সময়ই মাছে ফরমালিন ব্যবহা করা হয়ে থাকে।
ফরমালিনের ব্যবহারমাত্রা ও পদ্ধতি : দেশের বিভিন্ন বাজারের মাছ বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানা যায়, মাছকে সতেজ রাখার জন্য ড্রাম কিংবা বালতিতে পানির সঙ্গে ফরমালিন মিশ্রিত করে মাছকে অল্পক্ষণ চুবানো হয় কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে সিরিঞ্জ দিয়ে মাছের পেটে অর্থাৎ নাড়িভুঁড়িতে ফরমালিন ঢুকানো হয়। দেহের অভ্যন্তরে ফরমালিন ঢুকানোর ফলে ক্রয়ের সময় ফরমালিনের ঝাঁঝালো গন্ধ ক্রেতা সাধারণ বুঝতে পারে না। মাছ কাটার পর অনেক সময় ফরমালিনের গন্ধ আংশিক বোঝা যায় কিংবা খাওয়ার সময় মাছের স্বাদহীনতা অনুভূত হয়। অনুরূপভাবে ছোট মাছকেও ফরমালিনযুক্ত পানিতে চুবিয়ে বিক্রির তথ্যাদি পাওয়া গেছে। বাজারে প্রাপ্ত ফরমালিনে (৩৭-৪০%) তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আছে বিধায় তা কখনও সরাসরি মাছে ব্যবহার করা হয় না। কারণ এতে ক্রেতারা ফরমালিনের ঝাঁঝালো গন্ধ সহজেই বুঝে ফেলবেন। তাই ঝাঁঝালো গন্ধ হয় না, মাছ সহজেই পচে না এবং দেখতে টাটকা লাগে এমন মাত্রায় ফরমালিন বাজারে মাছে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই সর্বনিম্ন কতমাত্রায় মাছে তা ব্যবহার হতে পারে এ নিয়ে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সর্বনিম্ন ১% ফরমালিনে রুই-কাতলা জাতীয় মাছ রাখলে ১ দিন পরেই পচন ধরে যায়। অন্যদিকে ৫% এর অধিক ঘনত্ব হলে ফরমালিনের ঝাঁঝালো গন্ধ সহজেই বুঝা যায়। এতে বুঝা যায়, বাজারে ১ থেকে ৫% মাত্রায় রুই জাতীয় মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ফরমালিন এবং ফরমালিনবিহীন মাছ চেনার উপায় : বাজারে ফরমালিনযুক্ত ও ফরমালিনবিহীন মাছ চেনার উপায় কী এ নিয়ে ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকালে ফরমালিনযুক্ত এবং ফরমালিনবিহীন রুই জাতীয় মাছে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ফরমালিনযুক্ত মাছের চক্ষুগোলকে ভেতরের দিকে ঢুকানো থাকে, শরীরের স্নাইম থাকে না, ফুলকা কালচেবর্ণে, দেহ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফরমালিনবিহীন মাছের চক্ষু স্বাভাবিক এবং লালচে বর্ণে হয়, স্নাইম থাকে, ফুলকা লালচেবর্ণে এবং দেহ শুষ্ক নয়। আমদানিকৃত রুই জাতীয় মাছে মূলত ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে বিধায় ক্রেতাদের সহজেই চেনার জন্য দেশী এবং বিদেশী রুই-কাতলার পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। দেশী রুই মাছ দেখতে অপেক্ষাকৃত লম্বাটে এবং দেহের সঙ্গে মাথার আকার সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একই আকারের রুইয়ের বক্ষ অপেক্ষাকৃত চওড়া এবং মুখ সরু ও উপরের দিকে সামান্য উঠানো। একই সমান লম্বা দেশী রুইমাছের চেয়ে মায়ানমারের রুইয়ের ওজন ১৮-২০% বেশি। অনুরূপভাবে, মায়ানমার থেকে আমদানিকৃত কাতলা একই সাইজের দেশী কাতলার চেয়ে স্বাস্থ্যবান, বক্ষ অপেক্ষাকৃত চওড়া ও ওজন ২০%-২৫% বেশি।
মাছে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয় পদ্ধতি : ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে এলডিহাইড পরীক্ষার মাধ্যমে মাছে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়েছে। এ ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে Tollen’s reagent ব্যবহার করা হয়েছে। Tollen’s reagent মাছে উপস্থিত এলডিহাইডের (ফরমালিন) সঙ্গে বিক্রিয়া করে পাত্রের গায়ে রূপালি রংয়ের (Silver mirror) প্রলেপ প্রদর্শন করে। এ জন্য এ ধরনের পরীক্ষাকে ‘সিলভার মিরর টেস্ট’-ও বলা হয়। ৫০ মিলি পানিতে ১.৮ গ্রাম সিলভার নাইট্রেট এবং ৪ গ্রাম সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড যোগ করলে দ্রবণে ধূসর রংয়ের তলানি পড়ে। এরপর পরিমিত পরিমাণে পাতলা এমোনিয়া দ্রবণ যোগ করলে ধূসর রংয়ের তলানি বিলীন হয়ে দ্রবণটি বর্ণহীন হয়ে পড়ে। এই বর্ণহীন দ্রবণে নমুনামাছ বা নমুনামাছের অংশ বিশেষ রেখে দিয়ে দ্রবণটি ৪০ সে তাপমাত্রায় ২ মিনিট তাপ দেয়া হয়। মাছে ফরমালিন থাকলে পাত্রের গায়ে রূপালি আয়নার মতো প্রলেপ দেখা দেয়। ফরমালিন না থাকলে এ ধরনের প্রলেপ বা রং দেখা যায় না। উল্লেখ্য, মাছে যত বেশি পরিমাণে ফরমালিন থাকবে রূপালি প্রলেপ তত গাঢ় হবে এবং দ্রুত বিকারের গায়ে তা দেখা যাবে। এই পদ্ধতি দ্বারা মাছে সর্বনিম্ন শতকরা ১ ভাগ পর্যন্ত ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয় করা সম্ভব।
মানবদেহে ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাব : ফরমালিন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ। তা শুধু খেলেই নয় ফরমালিনের (০.১ পিপিএম) গন্ধ শুকলেই মাথাব্যথাসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হতে পারে। তাই শুধু ভোক্তাদের জন্য নয় ফরমালিনযুক্ত মাছ বিক্রেতাদের জন্যও স্বাস্থ্যহানিকর। শতকরা ০.০৩.-০.০৪ ভাগ ফরমালডিহাইডযুক্ত মাছ খেলে পাকস্থলি ও গলায় অস্বস্তিবোধ হতে পারে। মানবদেহে ফরমালডিহাইড ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং এতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া ফরমালিন মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। ফরমালিনযুক্ত মাছ খেলে পাকস্থলি, ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে ক্যান্সার হতে পারে বলে চিকিৎসকদের অভিমত।
এই লেখার বানান বা অভিমত সংশ্লিষ্ট কর্তৃক সংরক্ষিত।
পূর্বে প্রকাশ :