উজ্জ্বল দাশ :: আজ
২০ মে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গালিমপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রক্তে
ভিজেছিল হিন্দু অধ্যুষিত গালিমপুরের মাটি। এ দেশীয় বিশ্বাস ঘাতক পাকবাহীনীর দোষর
রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকহানাদার বাহীনীর বুলেট
ঠাঁই পেয়েছিল গালিমপুরের শান্তি প্রিয় মানুষের বুকে।
গালিমপুরের ৩১টি তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল কুশিয়ারার তীর গালিমপুরের মাটি।
পাশাপাশি মা-বোনদের ঈজ্জত তারা লুটে হয়েনার দল উল্লাসে মেতেছিল। গালিমপুরের গণহত্যা
ভয়াবহ, নির্মম এবং পৈশাচিক। রাজাকার কালা মৌলভী-ধলা বান্দর,বাট্টি মাষ্টর, আব্দুল
আহাদ ছাদ, রুস্ত্তম
চৌকিদার আর তিন ফুটি ডাক্তারদের দাপটে প্রকম্পিত হয়েছিল
বালাগঞ্জের মাটি। গুলি খাওয়া নিরিহ-নিরপরাধ মানুষের আর্ত চিৎকার আর ইজ্জত হারানো
মা-বোনদের রোদনে আকাশ-বাতাস ভারী হলেও বিবেক হীন রাজাকার আলবদর, ঘাতক নরপিচাশদের কাছে তা ছিল বিজয়ের উল্লাস।
যেভাবে শুরু : ৫মে ১৯৭১ শনিবার। ধান কাটাকে কেন্দ্র করে
গালিমপুর ও ভল্লবপুর গ্রামবাসীর সংঘষ হলে উভয় গ্রামের বেশ ক’জন আহত হন। পরবর্তীতে
ভল্লবপুরের ৪/৫ জন কে ন্যাড়া করার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার জের ধরে পাকবাহিনীর দালাল রাজাকার মদরিছ আলী ১ জন খানসেনাকে নিয়ে ১৮মে
গালিমপুর গ্রামে আসে। গ্রমের পাশবর্তী হুরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জড় করায়
গ্রামবাসীকে। তারপর জানিয়ে দেয় শেরপুর পাকিস্থানী ক্যাম্পের ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা
করতে হবে গ্রামের ২জন কে।
নতুবা গালিমপুর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।১৯
মে বুধবার গ্রামের সুরেশ দাশ ও রাকেশ দাশ পাকিস্থানী ক্যাম্পে গেলে জনৈক ক্যাপ্টেন
বলে গ্রামে থাকতে হলে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। অনেক আলোচনা ও কাকুতি-মিনতির পর
সিদ্ধান্ত হয় পরদিন সকালে ফাজিলপুর গ্রামের মদরিছ আলীর কাছে ৩ হাজার টাকা দেওয়া
হবে। সেদিন রাতেই গ্রামের সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে পরদিন সকালে যথাস্থানে টাকা
দিয়ে শান্তি কার্ড (ড্যান্ডি কার্ড) নিয়ে এসে গ্রামবাসী নিশ্চিন্ত হন পাকবাহিনী আর
আসবে না।
সে দিনের বর্বরতা :
২০ মে বৃহস্পতিবার। দুপুর ১টার দিকে অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একদল পাকহানাদার বাহিনী বল্লভপুর হয়ে গালিমপুর গ্রামে আসে। এ সময় পাকবাহিনীর সাথে ছিল রাজাকার আব্দুল আহাদ(ছাদ মিয়া),রুস্ত্তম
উল্লা(রুস্ত্তম চৌকিদার) ও শেরপুর মাদ্রাসার শিক্ষক কালা মৌলভী। পাকবাহিনীর আকষ্মিক
উপস্থিতিতে বিস্মিত হয়ে যান গ্রামবাসী। তারা সাহস করে তাদের শান্তি কার্ড
(ড্যান্ডি কার্ড) দেখান। কিন্তু সে কার্ডের তোয়াক্কা না করে হানাদার
বাহিনী প্রথমে গ্রামের দেব ব্রত দাশ, দ্বিগেন দাশ, রাকেশ দাশ, সুরেশ দাশ,গুনমনি
দাশ, রামা কান্ত দাশ কে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি চালায় এবং নিমিষে ঝরে পড়ে ৬টি তাজা
প্রাণ। তারপর ধরে নিয়ে আসে ২৫জন কে যার মধ্যে ৪ জন ছিলেন কিশোর। সারিবদ্ধ ভাবে দাড় করিয়ে চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ৩১টি
তাঁজা প্রান কেড়ে নেওয়ার পর রক্ত পিপাস হায়েনার দল এলাকার শতাধিক হিন্দু বাড়িতে
লুটপাট শেষে আগুন লাগিয়ে দেয় একই সাথে নারীদের ইজ্জত লুন্ঠন শুরু করে। রাজাকারদের ইসারায় হানাদার বাহিনী গ্রামের পাশবর্তী ভৈরভ থলীতে গিয়ে ভৈরভ মূর্তি ভাংছুড়
করে। প্রায় ৪ ঘন্টা
বিরতিহীন তান্ডব শেষে পাকবাহিনী ও তাদের দোষররা এলাকা ত্যাগ করে আসার সময় ২জন নারীকে ধরে
নিয়ে আসে চকবাজার পাকিস্থানী ক্যাম্পে। ২দিন পর পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে
উক্ত দুই নারী ক্ষত-বিক্ষত দেহ
নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে
মুক্তি বাহিনীর সহযোগীতায় এই ২ নারীকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হানাদার বাহিনী
এলাকা ত্যাগ করার পর লুকিয়ে থাকা গ্রামের অন্যান্য পুরুষরা বেরিয়ে এসে লাশ গুলোকে
গণকবরে সমাহিত করেন।
শহীদ হয়েছিলেন যারা :
খোকা দাশ, নৃপেন্দ্র চক্রবর্তী, গুনমনি দাশ, জ্ঞানেন্দ্র দাশ, চত্ত রঞ্জন দাশ, ক্ষিরদ
রঞ্জন দাশ, অশ্বিনী কুমার চক্রবর্তী, সখি চরন দাশ, রামা কান্ত দাশ, বারীন্দ্র
কুমার দাশ, যোগেন্দ্র কুমার দাশ, নরেশ চন্দ্র সূত্র, মহানন্দ পাটনী, ঘটাই পাটনী,
সাধন দাশ, রাকেশ চন্দ্র দাশ, যামিনী মোহন দাশ, হর কুমার দাশ, চরিত্র
দাশ, অমূল্য দাশ, নদীয়া রাম দাশ, রাকেশ দাশ, দিগেন দাশ, সুরেশ দাশ, রনেন্দ্র বিজয়
দাশ, মটর চন্দ্র দাশ, লাল উল্লা, অশ্বিনি নাথ,তরনী চন্দ্র বৈদ্য,সদয় চন্দ্র বৈদ্য,
দেবব্রত দাশ।
সূত্র: দৈনিক সবুজ সিলেট।
সতর্কতা : পূর্বানুমতি ছাড়া এই লেখার হুবহুব ব্যবহার করা নিষেধ।