Thursday 17 May 2012

চকোলেট পাহাড়ের দেশে


ড: তানিয়া হোসেন : নারিতা এয়ারপোর্টে লবিতে যাচ্ছি সেইবুর উদ্দেশ্যে। সেইবু হচ্ছে ফিলিপাইনের একটি আইল্যান্ড। এবার বেশ কিছুদিন পর জাপান ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি। আজ আমি সত্যি ক্লান্ত। ২০১১ সালের মার্চ মাসে জাপানে ভয়ংকর ভুমিকম্প হয়। সেসময় ভাগ্যক্রমে আমি বাংলাদেশে ছিলাম। ভুমিকম্পের দু’দিন আগে আমি হঠাৎ করেই দেশে যাই। ভুমিকম্পের কারণে জাপানের
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ শুরু হতে দেরি হয় তাই আমারও ফিরে আসতে দেরি হয়। ক্লাশ দেরিতে শুরু হলেও সিলেবাস কমানো হয় না। অল্প সময়ে আগের বছরের সমপরিমান সিলেবাস পড়াতে হবে। ফিরে আসি ১৮ই এপ্রিল আর ক্লাশ শুরু হয় ২০শে এপ্রিল। ১৯শে এপ্রিল বিকেলে জানতে পারি যে তিনজন বিদেশি শিক্ষক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ফেটে যাওয়ায় বরখাস্ত দিয়েছেন এবং ওনাদের ক্লাশও আমাকে নিতে হবে। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও সমাজের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে আমি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। ফুকুশিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট টোকিওতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। ওটা ফেটে যাওয়ায় এখন পর্যাপ্ত পরিমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না সেহেতু অনেক এসকেলেটর ও এলিভেটর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জাপান এ বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না এবং সেটা জাপানের ব্যবস্থাপনা দেখলেই বোঝা যায়। জাপানে বিদ্যুৎ ছাড়া বাথরুমের ফ্লাশও কাজ করে না। প্রাণোজ্জ্বল এই দেশটি থমথমে হয়ে গেছে। দেশে যাবার আগের জাপান ও দেশে যাবার পরের জাপান দেখে আমি খুবই ব্যথিত। প্রথম যে ধাক্কাটা খাই সেটা হচ্ছে এয়ারপোর্টে। পযর্টকদের লাইনে একজন পযর্টকও নেই। যে দেশে প্রবেশ করতে তিনঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থাকতে লাগে সে দেশে আজ কেউ আসে না। এয়ারপোটের্র থমথমে ভাব দেখে আমার অসবম্ভ কান্না পায়। কেনো জানি এ দেশের মানুষের কষ্ট আমাকে অসম্ভব ব্যথিত করে। আজব এক ভালোবাসা আছে আমার এ জাতির প্রতি আমার।
এরপর আমি যখন ট্রেনের প্লাটফর্মে যাই তখন দেখি ট্রেন লেইট। জাপানে এটা খুবই বিরল। এখানে সেকেন্ডের সাথে জীবন চলে। আমার এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে খেলাম সবচেয়ে বড় ধাক্কা-ঘরের সবকিছু লন্ডভন্ড ও ভর্তি কাঁচের গুঁড়ো। দীর্ঘপথ ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে ঘর-পরিস্কার করে পরেরদিন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত কাজ পাওয়া-সব কিছু মিলিয়ে আমি পরাজিত। একা আমাকে সব কিছু সামাল দিতে হয়। জীবন যুদ্ধে আমি পরাজিত নারী না-তবে এবার আমিও ক্লান্ত।বিশ্ববিদ্যাল্যয়ের অতিরিক্ত কাজ আমাকে ক্লান্ত করেনি তবে ক্লান্ত করলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাকে আমার কর্মক্ষেত্রে যেতে হলে চারবার ট্রেন পাল্টাতে হয়। ভোরের অতিরিক্ত ভীড় আর বিদ্যুতের কমতির কারণে যে কোনো একটা লাইন লেইট হবেই আর একটা লেইট মানে আরেকটাও লেইট। তাই যে জায়গায় যেতে আমার লাগতো দেড় ঘন্টা এখন আমার সেখানে যেতে লাগে দু’ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা।
তাই ন’টার ক্লাশ ধরতে আমাকে ট্রেনে উঠতে হয় ছ’টা চল্লিশ মিনিটে। প্রতিদিনের এ জীবন। দু’ঘন্টা ট্রেনে দাড়িয়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচতলার অফিসে ওঠা-নামা এবং আবার ক্লাশ বিল্ডিং পযর্ন্ত পনের মিনিট হেঁটে পাঁচতলায় উঠে একটানা পাঁচটা নববই মিনিটের ক্লাশ পড়ানো আর সাথেতো আছেই জাপানের গরম। সাথেতো আছে খাতা দেখা, বই লেখা এবং লম্বা মিটিং এ যাওয়া। ঘরের কাজ করবার কোনো সময়ই নেই। এ ভুমিকম্প জাপানের অনেক কিছুরই পরিবর্তন করেছে-আমি যেহেতু সে সময় জাপানে ছিলাম না তাই এ পরিবর্তন আমার চোখেই বেশি ধরা পড়ছে। এর মাঝে কয়েকটি উদাহরণ হলো ট্রেনে মোবাইল ফোনে কথা বলা-এ কাজটি জাপানীরা কখনোই করতেন না কিন্তু এখন নির্দ্বিধায় তা করেন যদিও সবাই না তবুও কেঊ কেউ করেন। ট্রেন লাইনে পড়ে থাকতে দেখা যায় খালি পানির বোতল। জাপানকে আমার বেহেস্তের মতোন পরিস্কার বলে মনে হতো-আর এখন এদেশে এখানে সেখানে ময়লা দেখা যায়-এটা ভাবাই যায় না। মানুষের ব্যবহারেও এসেছে পরির্বতন। কোনোদিন আমি জাপানে জোড়ে শব্দ শুনিনি-কিন্তু এখন রাত তিনটায় পথের ছেলেমেয়েদের চিৎকার পাঁচতালা থেকেও শোনা যায়। ভুমিকম্প মানুষকে নিস্তেজ করে দিয়েছে-এখানকার মানুষ আতিশোকে কাতর হয়ে তাদের কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এদের যাবার কোনো জায়গা নেই। আমার মন এবার শাস্ত কারণ আমার একটি নিরাপদ আশ্রয় আছে এবং সেটি হচ্ছে আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই প্রথম বুঝতে পারলাম নিজের দেশের মর্ম। যতই খারাপ ইমেজ থাকুক না কেন বিশ্বে বাংলাদেশের -এ বিপদের দিনে আমার একটি যাবার জায়গা আছে কিন্তু এ উন্নত জাতির সে আশ্রয়টুকুও নেই বিধায় অস্থির হয়ে পড়েছে। জাপানের এ দিন আসবে তা জাপানীরা কোনোদিনও কল্পনাও করেননি এবং সে কারণেই নেই কোনো প্রস্তুতি-যেমন আমাদের দেশে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা জেনারেটর ব্যবহার করি কিন্তু ও দেশে মনে হয় কেঊ জেনারেটর এর নামও জানেন না। এত বেশি ক্লান্ত আমি জীবনে কখনো হইনি। জাপানীরা বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবার জন্যই-দিন চালিয়ে নিচ্ছেন কারণ দিন চালাতেই হবে।
যাই হোক জীবনে যত বড় ঝড়ই আসুক না কেনো তা এক সময় থেমে যায়। আমারো তাই হলো-ক্লাশ শেষে খাতা কাল জমা দিলাম আর আজ যাচ্ছি ফিলিপাইনের সেইবু আইল্যান্ডে শিরধারা মাসাজ করাবার জন্য। শিরধারা শব্দ থেকেই বোঝা যায় যে ওটা মাথার মাসাজ। এ মাসাজে গরম তেল কপালের টিপের জায়গায় ঢেলে দেয় এবং তারপর ওই তেল মাথায় উল্টো করে মাথায় আসে। সাধারণত ওই মাসাজ আড়াই ঘন্টা ধরে চলে। এতে যুগ যুগের ক্লান্তি চলে যায়। আমি অনেকবার আয়ুর্বেদিক মাসাজ করেছি এবং এবার যাচ্ছি ফিলিপাইনে মাসাজ করাতে।
সেইবু ফিলিপাইনের একটি আইল্যান্ড। যা আরো ১৬৭টি আইল্যান্ড দ্বারা বেষ্টিত। এটি একতি বীচ এলাকা। অনেকটা আমেরিকার হাওয়াই আইল্যান্ডের মতোন। রিলাক্সের জন্য বিখ্যাত। ওখানে সময় ধীরে চলে। ফিলিপাইনের অন্যান্য স্থানের চেয়ে সেইবু অনেক উন্নত। গ্রীষ্মের ব্ন্ধ কাটাবার জন্য এই একটি উত্তম জায়গা। এবার সাথে আমার কোনো ব্যাগ নেই। ব্যাগ ভেঙ্গে গেছে বাংলাদেশ থেকে জাপানে আসবার সময়। আসার সময় স্কেলে ব্যাগ দিয়েছি আর সাথে সাথে সুন্দরভাবে তা দু’ভাগ হয়ে গেলো। সব দেশে রেখে খালি হাতে জাপানে চলে আসি। এবার সাথে মাত্র আট কিলোর একটি হ্যান্ড ব্যাগ। সেটাকে চেকইন কাউন্টারে দিয়ে দিলাম। তেলের দাম বেড়ে যাওয়াতে প্লেনে উঠতেই ভয় লাগে-উঠলেই দু’হাজার ডলার। যাচ্ছি কোরিয়ার এয়ারলাইনস আসিআনা এয়ারলাইনস এ। কাউন্টারের স্টাফদের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। মেয়েগুলোর মাঝে কেমন যেনো একটি মমতার ছোঁয়া আছে। মন ভালো হয়ে যায় এয়ারপোর্ট থেকেই। তাদের কথা বলার ভঙ্গিতে মন ভরে যায়। কেমন জানি ভালোবেসে কথা বলে। কোরিয়া থেকে জাপান দু’ঘন্টার ফ্লাইট। ছোট প্লেন তবে সার্ভিসের কোনো তুলনা হয় না। অনেক দেশ ভ্রমণ করে আমার একটা উপকার হয়েছে এবং সেটা হলো আমার মনে হয় আমি পৃথিবীর সব ভাষাই বুঝি। পৃথিবীর কোনো ভাষাকেই কেনো জানি অপরিচিত মনে হয় না। যেমন আজকের এই ফ্লাইটে বেশির ভাগ যাত্রীই ছিলেন কোরিয়ান তাই ফ্লাইট এটেনন্ডেণ্ট আমার সাথে ভুলে কোরিয়ান ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন,‘‘তুমি কি কফি চাও’’। আমি ইংরেজিতে বললাম,‘‘ইয়েস’’। উনি সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,‘‘হেয়ার ইউ গো’’। আমি তখন খেয়াল করলাম যে উনি কোরিয়ান ভাষায় কথা বলছিলেন।ফ্লাইট নামলো কোরিয়ার ইনচং এয়ারপোর্টে। ভুলে গিয়েছিলাম যে ওটা কোরিয়া। জাপানের মতনই উন্নত। কোরিয়া বিশ্বে তার জানালা খুলেছে। এ জাতির উন্নতিও খুব শীঘ্রই হবে বলে আমার বিশ্বাস। এয়ারপোর্টের ট্রানজিট চেকিং এর ট্রেতে লেখা, “have a safe Journey”-পৃথিবীর কোনো ইমিগ্রেশনে এটা আমার চোখে পড়েনি। কোরিয়ান অফিসারদের ব্যবহারে আছে কোমলতা, ভাষায় আছে নম্রতা আর ভালোবাসা। আল্লাহর রহমতে ভালোভাবেই যাত্রা শুরু হলো। কয়েক মাসের কষ্টটাও কিছুটা হলেও ভুলে গেলাম। বিকেল চারটা বাঁজে -অপেক্ষা করছি পরবর্তি ফ্লাইট ধরবার জন্য। বসে থাকতে থাকতে একজন বৃদ্ধ মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘‘তুমি কি সেইবুতে যাবে?’’ আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ’’। শুরু করলেন-কথা আর কথা। বিশ মিনিটে ওনার চৌষট্টি বছরের সমস্ত ইতিহাস বললেন। ওনার জ্ন্ম সেইবুতে- সাত বছর আগে উনি আমেরিকাতে গেছেন। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করেন। চৌদ্দ ঘন্টা জার্নি করে ক্লান্ত এবং কারো সাথে কথা না বলতে পেরে পরিশ্রান্ত। দেড় ঘন্টা কথা শুনে মাথা ধরে যাওয়ায় আমি ভাবলাম কফি কিনে আনি। কফির সাথে বার্গার আর্ডার করলাম। কেচাপ চাইলাম। দোকানদার বললেন, কেচাপ দেয়া হ্য় না ঐ বার্গারের দোকানে তবে দোকানদারের কাছে বার্গার কিং থেকে আনা কেচাপ আছে, আমি চাইলে তা নিতে পারি। উনি বার্গার কিং থেকে খাবার সময় তা নিয়ে এসেছিলেন এবং সেটা আমাকে উপহার স্বরুপ দিলেন। এ রকম ব্যবহার পৃথিবীর কোনো দোকানদারই করবেন না বলেই আমি জানি। বার্গার কিনে এসে দেখি মহিলা আরেকজনকে ধরেছেন। ভদ্রলোক আমাকে নানান প্রশ্ন করলেন এবং জিজ্জাসা করলেন যে সেইবুতে কি আমরা ট্যাক্সি ভাড়া শেয়ার করতে পারি কিনা? আমি তাতে রাজি হতে পারলাম না কারণ ফ্লাইট নামাবে রাত বারোটায়, এতরাতে একজন অপরিচিত লোকের সাথে ট্যাক্সিতে ওঠা ঠিক হবে না। ভদ্রলোক একা এসেছিলেন এবং ভাষাগত সমস্যা থাকার কারণে এবারো প্লেনে উঠতে সমস্যা হলো কারণ উনি ফ্লাইট মিস করে নতুন ফ্লাইট নাম্বার পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু নতুন ফ্লাইটের জন্য চেকিংও করেননি এবং বোর্ডিং পাসও নেননি। যখনই জিজ্জাসা করা হয় আপনি কি করেন ঠিক তখনই উনি বলেন,‘‘সিকরেট’’। তাই সবাই ওনাকে ডাকতে লাগলো,‘‘মিঃসিকরেট’’।
মিঃসিকরেট প্লেনের গেট বন্ধ হবার তিন মিনিট আগে প্রবেশ করলেন এবং সিট পরলো আমার পেছনে। ওনার বুকের ধ্বক ধ্বক শব্দ আমি সামনের সিট থেকেও শুনতে পারছিলাম। বৃদ্ধ ভদ্রমহিলাও বসেছিলেন আমার পাশের সিটে। প্রতি একসেকেন্ড পরপর উনি আমাকে ‘‘এক্সকিউজমি’’ বলে একটা করে প্রশ্ন করেন। ঘুমের ভান করে থেকেও কোনো লাভ নেই। ঘুমালেই হলো, এক্সকিউজমি বলে,‘‘টয়লেটে’’ যেতে চান। ওনার সিট ছিলো জানালার পাশে আর আমার সিট ছিলো আইলের ধারে। চারঘন্টা পার হলো এবং ফ্লাইট নামলো ফিলিপাইনের সেইবু এয়ারপোর্টে। রাত তখন বারোটা পাঁচচল্লিশ মিনিট। আমাকে একা হোটেলে যেতে হবে। এবার কেনো জানি অসম্ভব ভয় লাগলো। মনে হয় ফিলিপাইন সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণা আছে বলে। একজন সিকিউরিটিকে ডাকলাম এবং বললাম আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে। ট্যাক্সি এসে পৌঁছালো হোটেল নর্থউইন্ডের সামনে। হোটেল দেখেতো আমার মেজাজ ১০০০% গরম হয়ে গেলো। একটু বেশী পঁচা হোটেল। কনফারেন্স অরগানাইজার ঐ হোটেল আমার জন্য বুকিং করে রেখেছিলেন। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম রিসিট দিতে, উনি সাথে সাথে বললেন, ‘‘নো পেপার সরি‘‘। উনি কোনো খুচরা টাকাও আমাকে ফেরত না দিয়ে বললেন,‘‘এটা আমার ভালো সার্ভিসের জন্য বকসিস’’এবং সাথে সাথে চলে গেলেন। প্রথম রাতের এই ঘটনা আমাকে খুবই ব্যথিত করল। তার চেয়েও বেশি মন খারাপ হলো হোটেলে চেকিং করবার সময়। আমি যখন হোটেলে পৌঁছাই তখন বাজেঁ রাত দু’টার মতোন। কিন্তু মহিলা ন’তারিখ থেকেই টাকা নেবেন। পঞ্চাশভাগ টাকাও তিনি নেবেন না। অন্য সব স্টাফ রাজি কিন্তু মহিলা নাছোর বান্দা। অবশেষে হার মেনে একদিন আগে থেকে টাকা দিয়ে চেকিং করলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম মাসাজ করাতে। দু’ঘ্ন্টা মাসাজ করে গেলাম ট্যুরের খোঁজ নিতে। সিদ্ধান্ত নিলাম যে পরের দিন ফিলিপাইনের পথের ট্যুরের জন্য বিখ্যাত বহোলে বেড়াতে যাবো। সব খোঁজ খবর নেয়া শেষ করে দুপুরের খাবার খেলাম। গ্রীল মিল্ক ফিস, সিব্জ আর ভাত। ফিলিপাইনের খাবার অসাধারন। একটা সস বানাতে হয় নিজে নিজে ছোট ছোট লেবু চিপে, সাথে ছোট লাল মরিচ, সয়া সস ও ভিনেগার। যে কোনো কিছুর সাথে অসাধারণ লাগে। খাবার শেষে শুরু হলো ম্যারাথন মাসাজ। টানা চার ঘন্টা মাসাজ করে রাতের খাবার খেয়ে দিলাম ঘুম কারণ পরেরদিন বহোলে যেতে হবে।
সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠলাম। কারণ সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে আমাকে পিয়ারকোট ফোর ফেরিঘাটে একা একা যেতে হবে। সকালে ফেরিঘাটে গিয়ে আমি একেবারে অবাক! জাপানের সুপার এক্সপ্রেস ট্রেনের চেয়ে হাজার গুনে সুন্দর। ফেরি ছাড়লো সাড়ে আটটার সময়। ফেরি না ট্রেন না বাস বুঝতে পারলাম না। কিসের ওপর দিয়ে পানি না মাটি না আকাশের ওপর দিয়ে চলে তাও বুঝতে পারলাম না। যাত্রাটি খুবই মনোরম। দু’ঘন্টা পর বহোলে পৌঁছে গেলাম।
বহোলে পৌঁছাবার পর ট্যুর গাইড এলেন। উনি হলেন একজন মহিলা নাম নারিসা। ওনার অভিনন্দনের ঢং দেখেই বুঝতে পারি যে মহিলা অভিজ্জ ট্যুর গাইড। বহোলে অনেক তিন চাকার স্কুটার এর মতোন দেখা যায়। প্রতিটার পেছনে ধর্মীয় একটি বাক্য লেখা থাকে। মুসলিম ড্রাইভার হলে পবিত্র কোরআন থেকে একটি বাক্য, হিন্দু হলে গীতা থেকে একটি বাক্য ও খ্রীষ্টান হলে বাইবেল থেকে একটি বাক্য লিখতে হবে।না লিখলে লাইসেন্স মিলবে না। বহোল খুব সুন্দর একটা শহর। সর্বমোট ১২ মিলিয়ন জনসংখ্যা। কোনো বড় বিল্ডিং নাই এবং সব দোতলা বাড়ী। বাড়ীগুলো একটু রাস্তার ওপরে আছে সে কারণে সরকার ভেঙ্গে ফেলতে চান কিন্তু জনগনের চাপে সরকার সেটা করতে পারেনা।
যাবার পথে আমরা গার্ডেন কফি নামের একটি কফি শপে নামলাম। ঐ কফি শপে সব অর্ডার লিখে দিতে হয় কারণ ওয়েটার ও ওয়ের্টেস সবাই কানে শুনতে এবং সাধারণভাবেই কথা বলতে পারেননা। একটি এন.জি.ও ঐ কফিশপের প্রতিষ্ঠাতা। কফি খেয়ে ব্লাড কমপেক্ট মনুমেণ্ট দেখতে গেলাম। বহোল হচ্ছে সে শহর যে শহর থেকে প্রথম ফিলিপাইন ফ্রেঞ্ছদের কলোণীতে পরিণত হয়। আসলে কোলোণী যুদ্ধটা হয় একটি নৌকাতে যেহেতু সে স্থানে যাওয়া সম্ভব না তাই তার কাছে একটি মনুমেণ্ট তৈরি করা হয়েছে। মনূমেণ্ট দেখে আমি সুভিণীর কিনতে গিয়ে দেখি বাস আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আর আমি বাসের পিছনে পিছেন দৌড়। যাই হোক বাস থামলো এবং রওনা হলো বাদিয়ান চাচের্র উদ্দেশ্যে। এবারের সফর সঙ্গীরা ছিলেন আমেরিকা থেকে আগত ফিলিপাইনী বংশদ্ভুত একটি দশজনের গ্রুপ, একটি স্পানিশ দম্পতি, একটি সাদা ও ফিলিপাইনী দম্পতি ও একটি জাপানী ছেলে। একবার হারিয়ে যাওয়াতে সবাইতো আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাই যেখানে যায় আমার হাত ধরে রাখে।
বাস এসে থামলো বাদিয়ান চাচের্র সামনে । একজন গাইড এলেন আমাদের ঐ চাচের্র ট্যুর করাবার জন্য। জানতে পারলাম যে চার্চটি স্পানিশরা নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ করতে সময় লাগে প্রায় দু’শ বছর। নির্মাণ শুরু হয় ১৫৯৬ সালে এবং শেষ হয় ১৭২৭ সালে। চার্চটিতে কোনো সিমেণ্টের প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়নি। যা ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে সমুদ্রের বালু, ডিমের সাদা অংশ এবং লেবুর সবুজ খোসা। একটুও পানি ব্যবহৃত হয়নি। আমি এতো বড় চার্চ পৃথিবীর কোনো দেশে দেখিনি। এটা বহোলের সবচেয়ে পুরনো চার্চ। বহোল ফিলিপাইনের দশম বৃহত্তম দ্বীপ।
চার্চ দেখে এলো দুপুরের খাবারের পালা। দুপুরের খাবার হবে বাঁশের নৌকাতে এবং যতক্ষণ খাবার-দাবার চলবে ততক্ষণ নৌকা চলবে। চারিদিকে গাছ-গাছালিতে পরিপুর্ণ, শ্যামল-শীতল নদীর মাঝে নৌকা চলতে লাগলো-শুরু হলো গান। নৌকা বয়ে চললো ঝর্ণার পাশ দিয়ে, অবর্ননীয় অনুভূতি। নৌকা থামলো একটি গ্রামে। গ্রামের মেয়েরা আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন, নাচলেন-গাইলেন এবং একই সাথে আমরাও নাচলাম। অসম্ভব সুন্দর অনুভুতি। বিদায় নিয়ে আমরা চললাম চকলেট হিলসের উদ্দেশ্যে।
চকলেট হিলস বহোলের একটি অন্যতম আকর্ষণ। পঞ্চাশ কিলোমিটার বিস্ত©র্ৃত এ জায়গায় মোট ১৭৭৬টি চকলেটের মতন ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে। গ্রীষ্মের দিনে এ পাহাড়ের ঘাসগুলো চকলেটের মতন রং ধারন করে তাই এ পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে চকলেট হিলস। চকলেট হিলস পর্যটকদের কাছে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। কথিত আছে যে একজন আমেরিকান পযর্টক এই পাহাড় দেখে মন্তব্য করেন যে এই পাহাড়গুলোকে দেখতে চকলেটের মতোন লাগে এবং এরপর থেকেই ঐ পাহাড়গুলোর নামকরণ করা হয় চকলেট হিলস। পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে হলে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এবং ঐখানেও আছে মনবাসনা পূর্ণ করবার পাত্র। পাত্রে আমি নিয়ম মতোন টাকা দিলাম এবং বিগত দশ বছর ধরে যে সমস্ত অনুরোধ আমি করছি সেটা আমি আবারো করলাম। এবার দেখা যাক কি হয়? চকলেট হিলস অনেক সময় ধরে দেখলাম। প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। এত সুন্দর পাহাড় আমি জীবনে কখনো দেখিনি। অনেক সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম প্রজাপতির রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
প্রজাপতি কথাটা শুনে মনে হয় ও প্রজাপতি! আমি প্রজাপতির ফার্মে প্রবেশ করে খুবই আবাক হলাম ও একই সাথে আনন্দিত হলাম। জানতে পারলাম যে প্রজাপতির গড় আয়ু দু’থেকে তিন সপ্তাহ। প্রজাপতির গর্ভ ধারণ করতে একদিন সময় লাগে। মানে চবিবশ ঘন্টা দৈহিক মিলন করতে হয়। মেয়ে প্রজাপতি ওপরে ওঠে এবং ছেলে প্রজাপতি নীচে থাকে। ডিম পারার পর প্রজাপতি হতে দু’দিন সময় লাগে। সে সব প্রজাপতির দু’টো পাখা দু’রঙ্গের হয় তারা হিজরা প্রজাপতি। তারা কখনো সন্তান উৎপাদন করতে পারবে না। সে সব প্রজাপতির দু’টো পাখাই এক রঙ্গের হয়ে থাকে তারা হয় ছেলে অথবা মেয়ে প্রজাপতি। মেয়ে প্রজাপতির বুকের অংশ ছেলে প্রজাপতির চেয়ে লম্বা হয়ে থাকে।
প্রজাপতির ফার্ম দেখা শেষ করে আমরা চলে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বাণর টারশিয়ার দেখতে। টারশিয়ার আমার মনে হ্য় এ নামটি অনেকেই শোনেননি। এটি হচ্ছে বানরের সবচেয়ে ছোট প্রজাতি। আমারতো দেখে মনে হলো যে তাদের দেহে প্রাণ ছাড়া আর কিছূই নেই। চড়ূই পাখীর মতোন ছোট বানর। খুবই আদুরে স্বভাবের। কোলে নিতে ইচ্ছে করে অথবা পালতে ইচ্ছে করে কিন্তু কোনটাই করা যায় না কারণ এরা খুবই সেন্সেটিভ। বনের নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও আনলেই তারা আত্মহত্যা করে-হয় তারা মাথা ঠুকরে মারা যাবে অথবা তারা সারাদিন না খেয়ে মারা যাবে। অনেক সময় এদের সাথে সময় কাটিয়ে রওনা হলাম সেইবুর উদ্দেশ্যে।
সকাল ৯টায় বাস ছাড়বে সেইবু সিটি ট্যুরেরে উদ্দেশ্যে। এবারের সফর সঙ্গী পঞ্চাশজন বিদেশী পযর্টক। যেহেতু সিটি ট্যুর সে কারণেই লোকাল লোকজনদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই-এ ট্যুরের প্রতি। প্রথমেই গেলাম টাওইষ্ট টেম্পলের উদ্দেশ্যে। টেম্পলটি শহর থেকে একটি দূরে তাই শহরের কোলাহল থেকে একটু স্বশিত পাবার জন্য ওটা একটি অন্যতম জায়গা। শহর থেকে একটু ঊচূতে বলেই ওখানে যেতে ৮১টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ৯টি ধাপে ধাপে উঠতে হয় ৮১টি সিঁড়ি। আমার মতোন সুঠাম দেহিদের জন্য ওটা বেয়ে ওঠা খুব বড় একটা ব্যাপার না কিন্তু যারা শারীরিক ভাবে দুর্বল তারা অবশ্যই ওখানে ওঠার আগে একবার ভাববেন। এই টেম্পলে আগরবাতি জ্বালিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনটি প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্ন করে দু’টো লাঠি ছুড়ে দিতে হয়-যদি দু’টো লাঠি উল্টোভাবে পড়ে তবে প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হবে তবে দেরি হবে আর যদি একটা লাঠি সোঁজা আর আরেকটা লাঠি উল্টা হয় তবে যা চাওয়া হয়েছে তা খুব তাড়াতাড়ি আসবে। আর যদি দু’টো লাঠিই সোঁজাভাবে পরে তবে তা পেতে যুদ্ধ করতে হবে। আমার দু’টো প্রশ্নের উত্তরে লাঠি সোঁজা পড়ল মানে হলো যে ওটা পেতে যুদ্ধ করতে হবে এবং একটার ঊত্তরে একটা লাঠি সোজাঁ ও আরেকটা উল্টো পড়লো মানে হল সেটা পেতে সহজ হবে। একেবারে মিলেও গেলো জীবনের সাথে। ভাগ্য পরীক্ষা করতে করতে শুরু হলো বিদ্যুৎ চমকানো সহ ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে শহরটাকে একদম অন্যরকম লাগলো। খুব ভালো লাগছিলো সেদিন আমার। বৃষ্টি একটু কমলে আমরা গেলাম সানতো নিনো দেখতে।
সানতো নিনোতে শিশু জেসাসের মুর্তি রাখা আছে। সবাই তাকে দেখে হাতছানি দেয় আমিও দিলাম। এ চার্চটি পাথরের গুড়ো, ডিমের সাদা অংশ ও লেবুর সবুজ খোসা দিয়ে নির্মিত। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে সানতো নিনো ভ্রমণের রক্ষাকারী। তাই সবাই সানতো নিনোতে গেলে একটি শিশু যীশুখ্রীষ্টের মুর্তি কেনেন। যেহেতু আমি অনেক বেশি ভ্রমণ করি সে কারণে আমিও একটি মুর্তি কিনলাম।
এরপর আমরা গেলাম একটি ছোট গ্রামে-যাখানে সবাই লোকাল সুভিনীর বানায়। খুবই সস্তা। সবাই যত ইচ্ছা তত সুভিনীর কিনলো এবং শেষে বাস আমাদের নামিয়ে দিলো আমাদের হোটেলের সামনে।
ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। ওনাদের চেহারাও অনেকটা আমাদের মতোন। অন্যান্য দেশের মতোন ওখানেও আমার সাথে সবাই ফিলিপাইনি ভাষায় কথা বলছিলেন। আমার চেহারাটাও মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল হয়ে গেছে-যে দেশেই যাই সে দেশের লোকই ভাবে আমাকে। তবে একটা বড় পাথর্ক্য হচ্ছে যে এদের সবার ব্যবহার অসম্ভব ভালো এবং সবাই খুবই ভালো ইংরেজী জানে-এমনকি যে কোনোদিন স্কুলে যায়নি সেও জানে। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা কেনো জানি ব্যবহার খারাপ করতে পছন্দ করি। ফিলিপাইনিদের মাঝে কেমন জানি একটা সুখী-সুখী ভাব। ওনাদেরকে আমার অনেক বেশি মমতাময়ী মনে হয়েছে। এয়ারপোর্টে বিদায়ের সময় ইমিগ্রেশন আফিসার আমাকে হাসিমুখে বলেন,‘‘আবার দেখা হবে’’। এটা আমাদের দেশে আশা করাটা অন্যায় হবে। এ গরীব দেশের মানুষের ব্যবহারও সাতদিনের অতিথির বিদায়ের বেলায় চোখে পানি নিয়ে আনতে বাধ্য করে। এ দেশের মানুষের কাছেও আমাদের শিক্ষার অনেক কিছু আছে-তা হচ্ছে নির্মল হাসি ও সুন্দর ব্যবহার।
লেখক :
ড: তানিয়া হোসেন
এই লেখার বানান বা অভিমত সংশ্লিষ্ট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত