Sunday 29 July 2012

বিলুপ্ত প্রায় প্রাচীন ঐতিহ্য মাটির ঘর


মো: কয়েছ মিয়া :: একসময় মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি করা হতো গ্রামের ঘর-বাড়ি। এসব ঘরে গরমের দিনে ঠান্ডা এবং শীতের দিনে গরম অনুভূত হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও সময়ের পরিবর্তনে মাটির ঘর এখন আর নির্মাণ করছে না গ্রামের মানুষ। আধুনিক ও দীর্ঘস্থায়ী টিনসেট,পাকা ঘর নির্মাণে মানুষ ঝুঁকে পড়েছে। তাই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য মাটির ঘর এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন অনেক
গ্রাম আছে মাটির ঘর খুঁজে পাওয়া দুষ্প্রাপ্য।
জানা যায়, মাটি ও খড় দিয়ে নির্মিত ঘর এ অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য। এ ঘর পরিবেশবান্ধব হলেও যুগের তালে হারিয়ে যেতে বসেছে। ইটের ঘরের মত মাটির ঘর নির্মাণ করতে হয়। মাটি খনন করে ভিত্তি স্থাপন করে, কাঁদা-মাটি দিয়ে ইটের মত স্তর বাই স্তর গেঁথে তুলতে হয় মাটির ঘর। এক স্ত অর্থাৎ এক ফুট গেঁথে প্রায় ৭/৮ দিন ধরে শুকাতে হয়। এরপর আবার একটি স্তর গাঁথতে হয়।
এভাবে ১২/১৩টি স্তর গেঁথে তার উপর বাঁশ দিয়ে ছাদ তৈরি করে তার উপর মাটি দিয়ে লেপে দিতে হয়। তার উপর আবার বাঁশ ও খড় দিয়ে চারটি চালা তৈরি করতে হয়। চনের চাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া হত ঘরে চালা। এ ঘরের দরজা-জানালা ইটের ঘরের মতই তৈরি করতে হয়। এ ঘর অঞ্চল বিশেষে একইভাবে দোতলা তিনতলা ঘরও নির্মাণ করা হতো বলে জানান অনেক প্রবীন ব্যক্তি। অনেকে পার্টিশন দিয়ে ৪/৫ রুমবিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করে। আবার অনেকে এল প্যাটান ঘরও তৈরি করে। কালের বিবর্তনে এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের মাটির ঘর। এখন আর এ অঞ্চলের মানুষ মাটির ঘর নির্মাণ করে না। ব্যয় বহুল হলেও আধুনিক ও দীর্ঘস্থায়ী টিনসেট ইটের ঘর নির্মাণ করছে। ঝড় বৃষ্টিতে মাটির ঘর ভেঙ্গে পড়লে কিংবা নতুন করে ঘর নির্মাণের প্রয়োজন হলে মানুষ কষ্ট করে হলেও টিনসেট ইটের ঘর নির্মাণ করছে।
ওসমানীনগর থানার গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের মুতিয়ার গাঁও গ্রামের জিলু মিয়া জানান, অতি প্রাচীন এ মাটির ঘর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত। শহরের মানুষ বিদ্যুতের সাহায্যে এয়ারকন্ডিশনার মেশিন চালিয়ে আবহাওয়া ঠান্ডা-গরম করে। আমাদের গ্রামের মানুষের মাটির ঘর প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা-গরম হয়। মাটির ঘর গরমের সময় ঠান্ডা এবং শীতের সময় গরম থাকে। এছাড়া সাদিপুর ইউনিয়নের গজিয়া গ্রামের আমির হোসেনের সাথে,তিনি জানান এখন মাটির ঘর খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউই এখন মাটির ঘর তৈরী করছে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একসময় ওই ঐতিহ্যর কথা গেলে গল্পের মতো বলতে হবে,এছাড়া কিছুই নেই।
কিন্তু গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছনের চাল দিয়ে মাটির ঘর আর কেউ তৈরী করে না। হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ঘর। এক সময় গ্রাম বাংলার প্রত্যেক বাড়িতে ছনের তৈরী ঘর ছিল। দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে মাটির ঘর আর ছনের চাল ছিল অপরিহার্য। প্রচন্ড গরমে এই ঘরে শীতল পরশ বয়ে যেতো।
ঘর তৈরী বাশঁ ও ছন প্রচুর পরিমান পাওয়া যেতো। বাশঁ ও ছনের আবাদ ও কমে গেছে। কিন্তু বর্তমানে বাশঁ পাওয়া গেলেও ছন পাওয়া প্রায় দুষ্প্রাপ্য। একসময় শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার বসবাস করতো ছনের চাল দিয়ে তৈরী মাটির ঘরে।
তৎকালীন সময়ে একটি গ্রামে কেবল অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারেই টিনের ঘর ছিল। আর কদাচিৎ দালান ঘর চোখে পড়তো। এখন সেসব অতীত। বলে জানান অনেক বৃদ্ধরা।
মাটির তৈরী ঘরবাড়ি ক্রমে এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে ইট,বালি,সিমেন্টের তৈরী দালান কোটা। বর্তমানে এমন অবস্থা দাড়িয়েছে একটি মাটির তৈরী ছনের ঘর তৈরীতে যে অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে প্রায় দালানের তৈরী করা সম্ভব। তাই দরিদ্র্ পরিবার গুলোতে টিনের ঘর কিংবা দালান ঘর তৈরী হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরী ছনের ঘর।
প্রতিটি দেশের কিছু নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। এমনই আমাদেরও কিছু নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু নিত্যনতুন আধুনিকতায় আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য ভিনদেশী ঐতিহ্যর চাকচিক্য এর জন্য সুন্দর নাও হতে পারে। কিন্তু তাতে আমাদের ঐতিহ্যকে খাটো,ছোট করা বা অসুন্দর বলা যাবে না।
বর্তমান সময়ে এমন অনেক আছেন যে আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য ভুলে ভিনদেশী ঐতিহ্যর পেছনে দৌড়াচ্ছি। কিন্তু এতে আমাদের কোনো স্বার্থকতা নেই। বরং আমাদের একটা পুরোনো ঐতিহ্য চাপা দিয়ে চলছি। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মাটি ও ছনের ঘরের গল্প, কবিতার ছন্দে বা সাহিত্যর পাতায় বা যাদুঘরে দেখা ছাড়া কিছু থাকবে না।