Wednesday 2 May 2012

ভেজা বাতাসে গ্রামটাকে ভুল মনে হয়


আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির : এখনও বছর ঘোরে নাই। এইবার এই জীবনের একমাত্র ছুটি পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে যাওয়ার সময় খালি মনে হয় পথ বড় মায়াময়। পথের ধুলায় চোখ আটকে যায়, তবু মুগ্ধমতন তা দেখার উপায় নাই। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল, ততই বিভিন্ন পরিচিত মুখের শেষ মায়া দেখার সুযোগ, ততই মরণ-ঘুমভাঙা চোখে আলো এসে পড়বে পরিচিত চোখগুলোর গভীর থেকে।
জল এসে গড়িয়ে পড়বে বুকে। নদীর পাড়ের ভেজা বাতাসে গ্রামটাকে মনে হয় সবুজ গাছ আর মাটি-টিনের শান্তি-পাড়া। এখানে আগের জীবনে অনেক কষ্ট -সমস্যা-রাগ-হিংসা-ভেদ-রোগ ছিল অসংখ্য, কিন্তু জীবনের ওপার থেকে খানিক সময়ের দ্রুত ছুটিতে এসে মনে হয় ওইসব ঝামেলার নাম গন্ধও বুঝি নাই। আমের এলোমেলো পাতাগুলোতে কেমন পবিত্র দোলা, একলা পথের ঢালে আগাছা বা অনাকাঙ্ক্ষার লতাপাতা নিয়ম না মেনে খানিকটা পথ দখল করে আছে। এবার তবু চোখ ফেরাতে হয় , যত দ্রুত যাওয়া যাই ততই এ গ্রামের আপনমতন মানুষগুলোর শেষ কথা মন ভরে নিয়ে যাওয়া যাবে । অন্ধকার ঘরে অনন্ত অবসর! সেখানে শুধুই অবসর , কোন অপেক্ষা নাই, কোন দিনের শেষ-শুরু নাই, যোগাযোগ হয় না, মনের আপন কোন শরীর নাই!
আগের জন্মের শরীরটা ধার করে ষাট মিনিটের জন্যে আজকে আসা। গোরস্হানের পাশের বিশাল গর্ত পার হয়ে , নদীতে গা ধুয়ে পথ ধরতে ধরতেই লেগে গেল পাক্কা দশ মিনিট! বাকি আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট থেকে সাত আট মিনিট লেগে যাবে বাড়ি পর্যন্ত এই লম্বা পথ পার হতেই। বাড়ি পার হয়েও যেতে হবে আরও মিনিট পাঁচেক। গত রোজার ঈদে এই রাস্তায় কোমর-পানি ছিল। অন্তত পানি নাই বলে এবার রক্ষা। ঈদগাহ মাঠের মাইকের শব্দ আপ-ডাউন করে, মাঝেমধ্যে ঘরঘর আওয়াজ করে। এই মাঠের চিরকালের সমস্যা এইটা । সেই প্রায় নববই-পঁচানববই সন থেকে একবারও ভালো মাইক পাওয়া গেল না? আর পঁচিশ মিনিট পরে শুরু হবে ছয় তাকবিরের বছরের বিশেষ আনন্দ-নামাজ।
দ্রুত করতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়া লাগতে পারে। তবু যত তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজটুকু সেরে ফেলা যায়, তত তাড়াতাড়ি অজুহাত পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাড়ির ঢাল বেয়ে ওঠা বা ঘরের দুয়ারে দুয়ারে থামার পরিকল্পনা আসলে সুযোগের সদ্ব্যবহার। ছুটির প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল সোজা ঈদের জামায়াতে জমা হওয়া। আর তারপর যদি সময় থাকে , কিছু মিনিট হাতে থেকে যায় , তাহলে ফেরার পথে বাড়ির ঢালে থামা যাবে খানিক সময়ের জন্যে। কিন্তু এই মাঠের জামায়াতের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। এমনওতো হয়েছে , নির্ধারিত সময় থেকে আরও পৌনে এক ঘণ্টা পরে নামাজের শুরু। এবার যে তেমন হবে না , এর কোন নিশ্চয়তা নাই। তারচেয়ে বরং উজানপথেই বাড়ির কাজটুকু সেরে ফেলা যাক।
পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পার হয়ে গেল নিমেষেই। পথের আরও খানিকটা বাকি। তবু বাড়ির ঢাল আর বাঁশের ঝোপ দেখতে পেয়ে চোখ ভরে গেল। বাঁশঝাড়ের মাথার উপরে সূযের্র সুন্দর রোদ জ্বলছে। আরও একটু বাঁক পার হলে নজরে হঠাৎ চমকের মতো ফেলে যাওয়া ঘরগুলোর ছবি নাকের দুইপাশে এসে বিঁধল। চোখ ছাপিয়ে উঠতে লাগল তখন থেকেই। গলা ভিজিয়ে দিয়ে বুকটা, মনটা আজন্মের হাহাকারে মন দিল।
যখন বাড়িটা পুরোপুরি সামনে, যখন বাড়ির ঢাল বেয়ে ওঠাটা কেবল বাকি, তখন গা-হাত-পা কাঁপিয়ে দিতে ছোট ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েটা পুতুলের সাজে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল পথের দিকে। ভয়, আনন্দ বা আতিশয্যে সে অবচেতনায় চিৎকার করে উঠলে পাশে এসে দাঁড়াল ওর মা। অবাক হয়ে কথাছাড়াই থমকে গেল সে, সেখানে একে একে দশ-বারোজন নারী যখন জমা হল, প্রতিটি মুখেই তখন পরিচিত কান্নার রোল, প্রতিটি চোখেই তখন বিলাপের কালো ভাষা। ঘরে ঘরে যাওয়ার উপায় বা দরকার আর নাই। এখানেই , এই আজীবনের মায়ভরা রোদের নিচে , গাছের পাতা দিয়ে ছায়াকরা মাটি কত যে আপন! এখানে হাঁটু গেড়ে বসলে ঠান্ডা বাতাস খোলা নদী থেকে উঠে এসে , মাটির ঠান্ডা জমিন হয়ে চোখেমুখে এসে লাগে।
আকুল করা প্রতিটি বিলাপের ধাক্কায় মন শরীরের সাথে মিশে যায়। শরীর কাঁদতে কাঁদতে কেঁপে ওঠে।
অনেকে তাদের দু:স্বপ্ন আর শোকস্বপ্নের বর্ণনা করে যায় বিলাপের ফাঁকে ফাঁকে। সেসব স্বপ্ন বড় আপন। আর বর্ণনার সুর , দু:খ, শোক, সবই চিরদিনের চেনা।
কয় মিনিট পার হয়ে যায়, তা চিন্তায় আসে না। পাঁচ মিনিট দূরের মাঠ থেকে মাইকের ভাঙা আওয়াজ জানিয়ে দেয় ঈদের আনন্দ জামায়াতের বাকি আর ১২ মিনিট। এতক্ষণ ধরে জমে থাকায় পা আর উঠতে চায় না। তবু মূল কাজ তো করতেই হবে। উঠতে গেলেই মায়ের স্বপ্নের হাহাকার, স্ত্রীর অন্তরঙ্গ বিলাপ, কণ্যাতুল্য মেয়েদের আকুল আকুতিসহ সবকিছু ঘাড়ে চেপে ধপ করে আবার হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিয়ে যায়। মিনিটের পর মিনিট চলে যায়, শরীরে মিশে যাওয়ায় মনের আর এসব মনে থাকে না।
গ্রামের মসজিদের ওয়াক্তিয়া ইমামের কিনা জামায়াত ধরতে এত দেরি ! ঈদগাহ মাঠের আপ-ডাউন করা মাইকে ছয় তাকবিরের বিশেষ আনন্দ জামায়াতে নামাজ পড়ার স্পষ্ট নির্দেশনা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মসজিদের ওয়াক্তিয়া নামাজের এই যেনতেন গ্রাম্য ইমামের যদিও সেগুলো জানা, তবু তিন চার মিনিটের উঁচা-নিচা পথ পার করে প্রায় শুরু হয়ে যাওয়া জামায়াত ধরতে পারা কঠিন। এত দেরি করে অন্য যেকোন সাধারণ লোকের রওনা করা সাজে হয়ত, কোন ইমামের না। অবশ্য এই ইমাম তো আর কোন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করে আসে নাই। এর ইমাম হয়ে ওঠা কেবল পেটের দায়ে। মসজিদের এই চাকরি পাওয়ার আগে ছিল ‘মাস্টারসাহেব’। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল বা বয়ড়ার হাইস্কুলের না, পোস্টাফিসের মাস্টার, অফিসিয়ালি ডাকতে গেলে, সাব-পোস্টমাস্টার। দীর্ঘদিনের চাকরি। তখনও প্রতিবেলা চাকরির পর বসতে হয় নদীর বাঁধের উপর করা অল্পপুঁজির হোমিও ওষুধের দোকানে।
বাঁধ থেকে উটপিঠার পিঠের মতো করে অদ্ভুত ঢাল নেমে গেছে। এরপর যমুনার অল্পবিস্তরী শাখা। শাখার ওপারে বালুর চর খাক হয়ে থাকে চৈত-বৈশাখে। অতদূর থেকে বালুর বড় বড় স্তর উড়ে আসে একেকটা বাতাসে। ঝড়ের চাইতে অনেক অল্প বাতাসেই থরথর করে দোকানটা কাঁপতে থাকে।
পোস্টমাস্টারের হোমিও ওষুধের ছাপড়াঘরের উল্টোদিকটায় বাপের সূত্রে পাওয়া দখলি-জমিটা পতিত পড়েছিল বছরের পর বছর। এবার ঘর উঠল। ডিলারি দোকান। ঘরটার দু’দিকে চকচকে পাতলা টিনের বেড়া দেওয়া হল, সামনে ধাপাড় আর পিছনে মানে পুব দিকটায় আপাতত ছনের বেড়া । যমুনার বাতাস এসে ধপ করে বেড়ার উপর লাগে না । ভেন্না, কলা, বন্যা আর অন্যান্য আগাছে বাতাস বাড়ি খায়, টলমল করে , শনশন শব্দ করে।
এরপর থেকে বাড়তে লাগল পোস্টমাস্টারের সাথে সৌহার্দ্য। রমজান মাস আসে ১১ মাস পরপর। তখনকার রোজায় সন্ধ্যা হলেই উত্তুরে বাতাস আর যমুনার মাঝখানে ঠান্ডায় জমে থাকা বালুর আস্তরণ থেকে শীত উঠে আসে। মাগরিবের আজানে কাঙি্ক্ষত সন্ধ্যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। ইফতার করার জন্য মাস্টারের আমন্ত্রনে দোকানে বসতে হয় আধঘণ্টা আগে থেকেই। দোকানের পশ্চিম দেয়ালে গোটা গোটা অক্ষরের ইংরেজি তারিখ চোখ বড় করে তাকায়। ক্যালেন্ডারে হ্যানিমানের ছবি। সাক্ষাৎ আবিষ্কর্তার আশীর্বাদের লোভে প্রতি হোমিও দোকানির ঘরে এঁর ছবি হয়ত অনেকটা আবশ্যিক। ইফতারের মুড়ি, ছোলা আর ডালের বড়া দিয়ে যায় মাস্টারের ছেলে। ঢালের নিচে হাট বসে প্রতি রবি আর বৃহস্পতিবারে। সেখান থেকে কেনা হয় বুন্দিয়া। শীতের এই এক বড় সুবিধা, রবিবারে বুন্দিয়া একটু বেশি করে কিনে রাখলে বুধবারের ইফতার পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া যায়।
পোস্টাফিসের ঘরটা মাস্টারের ভালো লাগেনা। বাগবাটী, শাহানগাছা আর ভাটপিয়ারীর পোস্টাফিসগুলো রাস্তার ধারঘেষা, খোলামেলা। আর এখানকার পোস্টাফিসের আলাদা কোন ঘর নাই। হাসপাতালের যে দালানে কালাজ্বরের রোগিদের ভিড় হয় সিজন এলেই, সেখানকার একটা ঘরের সামনে লাল-সাদা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পোস্টাফিসটার ঠিকানা। এর চেয়ে দোকানের ঠিকানা চিনতে অনেক সোজা।
তখন সাবপোস্টাফিসগুলোতে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রির নিয়ম ছিল। বন্ধুত্বের খাতিরে জোর করে ধরলে পোস্টমাস্টার আর না করল না। বেনামে স্ট্যাম্প বিক্রি করে ধরা পড়লে অপরাধ জেনেও একদিন বেনামি দুইটা স্ট্যাম্প লেজার খাতার ভাঁজে লুকিয়ে এনে গোপনে ছেড়ে দিল তার হোমিও ফার্মেসির মুখোমুখি ডিলারি দোকানের এই বন্ধুতুল্য লোকটার হাতে। আশঙ্কাতীত ঘটণা ঘটল এর
সাত কি নয়দিন পর। চাকরি গেল! চোখের ভরাট জলের মতো মাস্টারের মনভরে রাগ জমা হল ।
এত দিনের পরিচিত কিনা ফুসলিয়ে এমন একটা কাজের দায়ী করে তাকে জনমের মতো ফাসায়ে দিল। তার নামে এখন আমতলার কোর্টে দুইটা মামলা ঝুলে আছে। হাজিরা বা হাজত দুইই হয়ত কপালে । বিশ্বাসের নামগন্ধধারী কেউ আসলে আর দুনিয়াতে থাকে না , থাকলে বিশ্বাস নামে তাকে চিনতে গেলে আসমানের মতো বিশাল বিশাল ভুল হয়, যমুনার প্রচন্ড গ্রোতের মতো মাটি ভাঙে, বালুর মতো জীবনের অবলম্বন পানির ঢেউয়ে মিশে চোখ আড়াল করে চলে যায়। দোষ যেমনই হোক , মূলত দোষী দু’জনের কেউই না। তবে অসাবধানতার দায় অনেক ক্ষেত্রে দোষের চেয়েও বিশাল রকমের বড় হয়ে ওঠে , তখন বিদ্যুতের চমক লাগে চোখে, বুক পুড়ে ওঠে বলে বিশাল খাকের স্তুপ জমা হয় যখন-তখন।
একসময় মামলার ঝাঁঝ কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে আসে। তখন বাঁধের উপর মলিন হোমিও ওষুধের দোকানের সামনের ঝাপ খুলে দিলে হা করে যমুনার বাতাস গিলতে থাকে বাক্স, বেঞ্চ, টেবিল-চেয়ার আর দুইটা ক্যালেন্ডার সর্বস্ব ঘর। হ্যানিমানজির ছবির উপর হালকা ধুলার প্রলেপ আর নিচের গাণিতিক তারিখগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। আরও একটি নতুন ক্যালেন্ডার, সাথে হ্যানিমানজির ছবি এনে লাগাতে হত। কিন্তু পুনরায় চালু করা দোকানদারির আট দিনের মাথায় , গ্রামের মসজিদের ওয়াক্তিয়া জামাতের নিযমিত ইমাম হওয়ার প্রস্তাব আসে সাবেক এই পোস্ট মাস্টারের কাছে। বেতনি চাকরি তাই অভাবের সময় লুফে নিতে হয়। মাঝারি সাইজের দাড়ি আরও লম্বা হয়। গায়ের পোশাকে ইসলামি পরিবর্তন আসে বিপ্লবের মতো। দোকান ঘর থেকে আলগোছে খুলতে হয় হ্যানিমানজির ছবি। আশির্বাদের মতো এই অবলম্বল খুলতে গেলে সে হঠাৎ আনমনা হয়ে চরের দিকে চোখ ছড়িয়ে দেয়। সেখানে সাদা বালু রোদে জ্বলছে, মাঝে মাঝে সবুজ আর পাতলা ফসলের জমি। সেখানে অবিরাম জাত-বেজাত পাখিদের ঝটিকা সফর প্রায় জীবন্ত। তার হাতের আঙ্গুল থেকে হোমিওগুরুর ছবি ঝুলছে, নিচে মেটে রঙের জমিন আর ওদিকে দুপুর ১টা পনেরোতে রোদ আকাশ থেকে ঝুলতে থাকে। বালু শুকিয়ে যায়, পানির জীবনবায়ু উড়ে উড়ে সেই ঝুলে পড়া রোদ জড়িয়ে ধরে শূণ্যে উঠতে চায়।
আপন কণ্ঠস্বরগুলো শোনার জন্যে বিদেহী আত্মার ভেতর মন কেমন করছিল। তুমি আমারে কি এখনও মাফ করো নাই, মাস্টার ভাই? আসলে আমি জানতাম না, লোকগুলা কিন্তু আমার ভালো আত্মীয় আছিল ,স্ট্যাম্পগুলার জন্যে এত বড় বিপদ নাজিল হবে তোমার উপর , ভাবিও নাই । তোমার কি মনে আসে , সেই বিপদের আগে প্রতি শীতের সময় রমজান মাসে তারাবীর আজান পড়ার সময় একসাথে দোকান বন্ধ করে নদীর দিকে পা মেলানো অবস্হায় বসে থাকতাম, গায়ে মাদারঙের চাদর থাকত? আমার জানাজা পড়ানোর সুযোগ পাওয়া উচিত আছিল তোমার , কিন্তু জুম্মাবারের দিন স্পেশাল ইমাম উপসি্হত থাকায় , সেই এর দায়িত্ব পায়। আমার আত্মা এজন্যে এখনও অনুতাপ করে প্রতি জুম্মার দিন, জানো না বোধ হয়।
তোমার এই ইমামের চাকরি করতে গেলে অপরাধ অপরাধ লাগে, আমি বুঝি। তারাবীর মোনাজাত মুখস্ত করতে আঠারো দিনের মতো সময় গেছে। মাসলা মাসায়েলের ব্যাখ্যা দিতে গেলে মাঝে মাঝে তোমার মনে দোযখের ভয়, সেই রকম আগুনের মতো বুক জ্বলে। মিলাদের সময় তোমার গলায় করুন সুর চড়ে না। তোমার খারাপ লাগে, শুকনা শুকনা লাগে। জুম্মার দিন বয়সে ছোট অন্য ইমামের পিছনে নামাজ পড়ার সময় একলা একলাই হিংসার মতোন বোধ হয়। তুমি আল্লাহর ভয়ে কুকড়ে কুকড়ে চেপে যাও, সোজা সেজদার জায়গায় চোখদুটো বন্ধ করে মনোযোগ দিতে হয় ।
আজকে এত দেরি কেন তোমার? আমি মনে হয় ছুটির শর্ত পূরণ করতে পারলাম না। কেউই পারে না। তাই হয়ত কেউই পরের ছুটি আর পায় না। ঈদের আনন্দ-জামাত শুরু হয়ে গেল, আমি পৌঁছানোর আগেই। তুমি ইমাম হয়েও ধরতে পারলা না! লোকজন কি বলবে ? আমার একঘণ্টার আর বাকি আছে কিনা হিসাব করার সাহস হয় না। মনে হয় এই খানেই শেষমতো বসে যাই। সময়ের চিন্তা পেটের, ভাতের চিন্তার চেয়েও ভয়ানক রকমের। গুণতে গেলেই ভয় লাগে। গতবার রোজার ঈদের সময় এইখান পর্যন্ত পানি ছিল। ফকির বাড়ির দুইটা নাও ডুবি ডুবি করে লোক নিয়ে গেল বারবার, এপার -ওপার, ওপার-এপার। আমি যাব যাব করে নৌকায় উঠলাম শেষ সময়। নামাজের জন্যে তখন পুরো ঈদ-জামাতের লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ও কাগজের ঝালড় লাগানো মাঠে ঢুকব ঢুকব, বছর আষ্টেকের একটা বাচ্চা আমারে লজ্জা দিল ঠিক ঐ সময়। আমার লুঙ্গির পিছনে গোবর ভরেছিল কয়েক ফোঁটা। জামাত পাছে রেখে ঘরের দিকে ফিরতে হল মাঝি ছাড়া নাও নিয়ে। তখনকার লম্বা সময় ফুরিয়ে গেল।
আজকের সময় সেইদিনের তুলনায় কত যে কম ! আজকের দিনে সেই তুলনায় মায়ার ছায়া বেশ বেশি! আজকে আমার বাড়ির মাটিতে তখনকার তুলনায় হাজারগুণ পিছুটান!’
মানুষের পর মানুষ, বুড়োর আগে পরে শিশু, জোয়ানের সামনে পিছে বয়েসি লোক………সবাই ঘরে ফিরেছে। ঈদের দিন এখন গ্রামময় বিকাল হয়ে সন্ধ্যায় মিলিয়ে গেছে। আজকে মাথার উপরে সময়কালের চাঁদ উঠলেও জোছনা নাই। গতবারও ছিল না। গতবার তবু গোরস্হানের সামনের খাদটা অমন বিশাল হয় নাই। লম্বা পথগুলো তখনও পানির নিচে। আমগাছের সংখ্যা এ গ্রামে এখন বেড়েছে।
বাদুড়-ঝোলা বিশাল গাব গাছটা আর নাই। নদীর পাড়ের ভেজা বাতাসে গ্রামটাকে ভুল করে মনে হয় কালো গাছ আর মাটি-টিনের শান্তি-পাড়া। ভালো লাগে। নতুন চাঁদ ডুবে গেলে অমাবশ্যার রাতের মতো কালো গাছগুলোকে আর চেনা যায় না। নদীর ওপার থেকে তখন রহস্যের খোঁজে বাতাস আসলে কেমনে জানি আছড়ে পড়ে গোরস্হানের বিশাল খাদে! গ্রামের সবার জন্য রাত শেষকালে ফুরাতে থাকে!
পূর্বে প্রকাশ :