মো. কয়েছ মিয়া
:: সিলেটি ভাষা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সিলেটি ভাষায় বলতে হয় ‘নিজের ঢোল নিজেই
পেটানো লাগে’ কারণ এক শ্রেণীর নামধারী জ্ঞানপাপীরা বারবার সিলেটি ভাষা নিয়ে
দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
এর মধ্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরী একজন। যাকে মনে হয় পুঁথিগত বিদ্যায় দিক্ষিত হয়েছেন। কারণ জানতে
হলে পড়তে হবে। কারো ইতিহাস না জেনে কুরুচী মন্তব্য করা অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী ছাড়া
কিছু নয়। ভাবতে পারেন আপনার লিখনি খুব ভাল। কিন্তু বাস্তবতা হল আপনি যা শিখছেন বা
লিখছেন তা হল কৌশল। আর কৌশল গ্রামের অশিক্ষিত মানুষও আয়ত্ব করতে পারে।
লেখক গাফফার চৌধুরী
সিলেটিদের নিয়ে কটুক্তি ও কুরুচী মন্তব্য করে লিখেছেন- ‘লাঙ্গল টু লন্ডন’ এবং
‘সিলেটি ভাষা কোন ভাষা নয় একটি উপভাষা’। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়
কুরুচীপুর্ণ মন্তব্য দেখতে পেয়ে সিলেটি ভাষার ইতিহাসটি তুলে ধরলাম। এবং এই ইতিহাস থেকে নিশ্চয় শিক্ষা নেবেন।
ইতিহাস থেকে
জানাযায়, সিলেটি জনগোষ্ঠি নিজস্ব ভাষার অধিকারী। সিলেটি ভাষা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ
আলাদা এবং প্রাচীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। সিলেটি নিজস্ব লিপি রয়েছে যাকে
‘নাগরী’ ভাষা বলে। পৃথিবীতে প্রায় ৮ হাজার ভাষা রয়েছে। এর
মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার সংখ্যা ৩ হাজার। এই ৩ হাজার ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে
এবং যা মানুষের মুখে উচ্চারিত আছে। বিশ্বের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার একটি এই সিলেটি
ভাষা।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়,
ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ভাষার বিবরণে উল্লেখ আছে এবং বাংলাদেশে দুইটি
ভাষা প্রচলিত। এর একটি বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি। সিলেটি ভাষা নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে
গবেষণা। কিন্তু প্রাচীন এই ভাষাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এখনো। পুরো বাংলায়
অনেকটা উপেক্ষিত রয়েছে সিলেটি ভাষা। সিলেটি ভাষার উপর এ পর্যন্ত বেশ ক’জন পিইএচডি
ডিগ্রী অর্জন করেছেন। এর মধ্যে বৃটিশ নাগরিকও আছেন। বর্তমানে আরো অনেকে বিশ্বের
বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিচ্ছেন। বৃটেনে সিলেটি ভাষা
শিক্ষার কয়েকটি ইন্সটিটিউট থাকলেও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানিকভাবে সিলেটি ভাষা শিক্ষার
কোনো ক্ষেত্র নেই। যার ফলে সিলেটি ভাষা মানুষের মুখে থাকলেও এর বর্ণমালা (নাগরী
লিপি) অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর ইতিহাসও। সিলেটি ভাষার প্রচলন
শুধু সিলেটেই নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটি।
গবেষকদের ধারণা,
ইসলাম প্রচারক সুফী দরবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মনের ভাব বিনিময়ের সুবিধার জন্যে
নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে। এই নাগরী
বা সিলেটী ভাষা শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল এবং ভারত
ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত লক্ষের ও বেশী। শুধু
গ্রেট বৃটেনেই সিলেটী ভাষা ব্যবহার কারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। বৃহত্তর সিলেটের
বর্তমান জনসংখ্যা এক কোটি।
লন্ডনের সিলেটী
রিসার্চ এন্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানাযায়, সিলেট
অঞ্চল সহ সমগ্র বিশ্বের বর্তমানে এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে সিলেটী।
অন্যান্য আধুনিক ভাষার মত সিলেটী ভাষারও একটি নিজস্ব বর্ণলিপি রয়েছে। ইংরেজী ভাষায়
যেমন ২৬টি বর্ণ রয়েছে, বাংলায় ৫০টি, ঠিক
অনুরূপভাবে সিলেটী ভাষায় ৩২টি বর্ণ রয়েছে। ইংরেজী ভাষায় ভাওয়েল বা স্বরবর্ণ হলো
৫টি । বাংলায় স্বরবর্ণ ১১টি (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ) সিলটী ভাষায় স্বরবর্ণ ৫টি (অ
ই ঈ উ ঊ)।
হিউয়েন সাঙ, আলবেরুনী, ইবনে বতুতা প্রমুখের
বর্ণনা মতে সিলেট একটি সমৃদ্ধ ও সুন্দর জনপদ ছিলো। হিন্দু
পুরাণ মতে সিলেট মহাশক্তির পীঠস্থান রূপে পূণ্যতীর্থ বলে গণ্য। ভূস্বর্গ হিসেবে
পরিচিত কাশ্মীরের রাজধানীকে যেমন শ্রীনগর নাম দেয়া হয়েছে ঠিক তেমনি বাংলার
আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটকে এক সময় শ্রীভূমি বলা হতো। গণমানুষের কবি দিলওয়ার
বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার উক্তি উল্লেখ করে একবার লেখেন, ‘‘কাশ্মীর পৃথিবীর
সৌন্দযের্র লীলাভূমি এবং সিলেট তার হৃৎপিন্ড।’’ পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সিলেটের
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘‘সিলেটের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ
করিয়াছে। এখানকার গাছ-গাছড়া, নদ-নদী সবই যেন কবিত্বময়। ইচ্ছা হয় এখানে বসিয়া যুগ
যুগ ধরিয়া সাধনা করি। এমন সুরম্য দেশে কবি-সাহিত্যিকের উদ্ভব না হইয়া পারেনা। তাই
দেখিতে পাই, সিলেট বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট আসন দখল করিয়া বসিয়া আছে। সিলেটের
প্রতিভা অসাধারণ। সাহিত্য ক্ষেত্রে সিলেট জেলা শীর্ষস্থানীয়।’’
বাংলাদেশের
মাতৃভাষা বাংলা হলেও সিলেটিদের মাতৃভাষা সিলেটি (ছিলটি) নাগরী বা প্রাচীন নাগরী।
সিলেটি ভাষা একটি পরিপূর্ণ সাবলীল ভাষা যা লিখা হয় নাগরী লিপি দিয়ে। বহুভাষাবিদ ড.
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে সিলেটী একটি ভাষা এবং বহু দিক দিয়ে এ ভাষা অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। সিলেটে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির অষ্টম জাতীয়
ইতিহাস সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী সম্পাদিত
স্মারকগ্রন্থ সিলেট দর্পণে এ সম্পর্কে ড. আলীর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে।
সিলেটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা বলব আমি প্রধানত ২ টি কারনে-
১. সিলেটি ভাষা
একমাত্র আঞ্চলিক ভাষা যে ভাষার নিজস্ব সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাকরণ এবং লিপি রয়েছে,
নাগরী লিপি।
২. সিলেটি ভাষা
একমাত্র আঞ্চলিক ভাষা যে ভাষা এখনো সিলেটের শিক্ষিত সমাজ বাংলা ভাষার পাশাপাশি
সাহিত্যে এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কাজকর্মে ব্যবহার করে
থাকেন। সিলটি ভাষা আঞ্চলিকভাবে ছিলটি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হলেও পৃথিবীর বুকে রয়েছে
এর আলাদা গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া সিলেটি ভাষা
নিয়ে আরো অনেক ইতিহাস রয়েছে, আছে অনেক প্রাচীন গ্রন্থ।
সিলেটি ভাষা
সম্পর্কে আরো জানতে পারেন এই লিংক থেকে
লেখক : সাংবাদিক