Thursday 6 June 2013

মহানবী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ মুযেযা মি’রাজ শরীফ

মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ :: বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ মুযেযা ছিল মিরাজ ভ্রমণ। যা কারো বেলায় হয়নি এবং হবেও না। যে ঘটনাটি আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে রজব মাসে মক্কার জমিন থেকে ঘটেছিল। পবিত্র মিরাজের ইতিহাস থেকে মানুষ যুগে যুগে সীমাহীন উপকৃত হয়েছে। আজও উপকৃত হচ্ছে এবং উপকার পেতে থাকবে।  মুযেযা কোন মানুষের বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তেমনি সর্বশ্রেষ্ট মুযেযা মিরাজের ঘটনা। মিরাজের মাধ্যমে নবী পাক বেহেশত, দোযখসহ বিভিন্ন আশ্চার্য ঘটনাবলী দেখে আসেন। দেখা করেন মহান আল্লাহর সাথে। সেখান থেকে নিয়ে আসেন
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুগপোযোগি জ্ঞান-বুদ্ধি ও কৌশল। যার ফলে মদীনার মাত্র ২৩ বছর জীবনে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অসংখ্য পাপীদের আযাব দেখে মানুষকে সতর্ক করে হেদায়াত করেছেন।
মিরাজ শব্দের অর্থ: মিরাজ আরবী শব্দ। যা ‘ উরুজুন’ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অর্থ হচ্ছে- উর্ধ্বগতি। এটার বিপরীত হচ্ছে- ‘যাওয়াল’ তথা- অবনতি। মেরাজ শব্দের অর্থ - উপরের দিকে উঠা বা ধাবিত হওয়া।
ইসলামের পরিভাষায়: হযরত মোহাম্মদ (সা:) যে রাতে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস হয়ে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে বহু উর্ধ্বে উঠে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে আবার ফিরে এসেছেন মক্কায় ঐ রাতে। সে রাত্রিকে বলা হয় পবিত্র মিরাজের রাত।
পবিত্র মিরাজের মূল উদ্দেশ্য: শাত্মনা এবং প্রশিক্ষণ: প্রতি কাজের ও ঘটনার একটি উদ্দেশ্য থাকে । তেমনি মহানবী (সা:) এর মেরাজেরও উদ্দেশ্য ছিল। মহানবী (সা:) এক আল্লাহর প্রতি মানুষদের আহবান করতে লাগলেন। কিছু লোক ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। তখন ঈমানদারদের সংখ্যা খুবই নগন্য। দ্বীনের দাওয়াত যতই দিতে থাকেন তথই হযরত মোহাম্মদ (সা:)‘র শত্রু সংখ্যা বাড়তে লাগলো। দিন যত যায় অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চললো। তিনি নানা বাধার সম্মূখীন হলেন। এমনকি এক পর্যায়ে সঙ্গী সথীসহ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে  শিয়াবে আবু তালীবে তিন বছর বন্ধি জীবন যাপন করেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে বন্ধি জীবন শেষে তিনি আনন্দের সাথে বাড়ী ফিরে গেলেন। সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ীও হলো না। অল্প দিন পরে নবীজীর সহধর্মীনী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা:) ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন হযরতের সুখে-দু:খে আপনজন। বিপদের পরম বন্ধু। এরপর ইন্তেকাল করেন আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালেব। যার কারণে চারদিকে শত্রু বেষ্টিত পরিবেশে হযরত মোহাম্মদ (সা:) দু:সহ বেদনা বেড়ে গেল। এ দু’জন ব্যক্তি হযরতের বিপদে ছায়াদানকারীর মত ছিলেন। নবীর প্রতি কেউ অত্যাচারের সাহস ফেতনা। তাদের অবর্তমানে কাফির গোষ্ঠি এবার নবীর প্রতি অত্যাচার শুরু করলো। জন্মভূমির মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে চলে গেলেন তায়েফ নগরীতে। এ সময় তাঁর সাথে ছিলেন হযরত যায়েদ (রা:)। যে চিত্মা নিয়ে তায়েফের মাটিতে গেলেন সেখানেও পেলেন অমানবিক অত্যাচার। রক্তাক্ত অবস্থায় তায়েফ থেকে চলে আসছেন। ফিরার পথে হযরত যায়েদ নবীকে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! মক্কার মানুষ আমাদেরকে অত্যাচার করলো, তায়েফেরও লোকেরা আপনার সাথে পৈশাচিক ব্যবহার দেখালো। এখন আমরা আর কোথায় যাব?  নবীজী তখন খুবই বিব্রতবোধ করছিলেন। এমনই সময় আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর হাবীবকে সুসংবাদ দিলেন যে, হে নবী আপনাকে দুনিয়ার মনুষ সম্মান  ও মার্যাদা না করলে তাতে কিছু যায় আসে না। আমি আপনাকে আমার আরশে আযীমে স্থান দিব। তাই আল্লহপাক তার হাবীবকে শাত্মনা দেয়ার জন্য এবং আগামী দিনগুলোতে কিভাবে দাওয়াত প্রচার করতে হবে তা বুঝিযে দেয়ার জন্য মহানবীকে (সা:) কে মিরাজের আহবান করেন। মক্কা জীবনের সমাপ্তি টানা আর মদীনার জীবন কিভাবে শুরু করবেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ রেখা লাভ করবেন মিরাজের মাধ্যমে তা দেখিয়ে দিব। আলস্নাহ দর্শনের মাধ্যমে মদীনার ২৩ বছরের মধ্যে মুক্তির দিশারী হযরত মোহাম্মদ (সা:) ইসলামের প্রদিপ শিখা জ্বালিয়ে দিলেন। যে আলো অন্দকারাচ্ছন্ন পৃথিবী আলোকিত হলো। পবিত্র মিরাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই।
মিরাজ কখন সংঘটিত হয়েছিল: মিরাজ সংঘঠিত হওয়ার তারিখ নিয়ে মত পর্থক্য থাকলেও নির্ভরযোগ্য মত হলো, মহানবী (সা:) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির একাদশতম বছরে এবং হিজরতের  প্রায় এক বছর আগে মেরাজ সংঘঠিত হয়েছিল। রজব মাসের ২৭তারিখ। অর্থাত- ২৬ রজব দিবাগত রাতে শবে মিরাজ হয়েছিল। সনটি ছিল ৬২০ মতাত্মরে ৬২১ খ্রীষ্টাব্দে। তখন মহানবী (সা:) এর বয়স ছিল ৫২ বছর। হাদিস শরীফে পবিত্র শবে মিরাজের বর্ণনা করেছেন, ২৪ জন পুরুষ ও ৪জন মহিলা সাহাবী। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, মিরাজের ঘটনা ২২ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সাহাবী বর্ণনা করেছেন।
কিভাবে মিরাজ সংঘটিত হয়: আরবী রজব মাসের ২৭ তারিখ গভীর রাত। রাতটি ছিল অমাবস্যর ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। গভীর নিদ্রায় প্রাণীকুল ও প্রকৃতি। এ রাতে হযরত জিব্রাইল (আ:) আল্লহ নির্দেশে ‘বুরাক‘ নামক বেহেশতী বাহন নিয়ে পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলেন। চাচা আবু তালেবের গিরি সংকটের সময় মহানবী (সা:) উম্মে হানীর (রা:) ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। জীব্রাঈল (আ:) এর সাথে ছিলেন ৩জন ফেরেশতা। তাঁরা মহানবী (সা:) কে কাবা ঘরে নিয়ে আসেন। উর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ সময় ফেরেশতারা রাসুল (সা:) এর বুক মোবারক বিদীর্ণ করে পবিত্র জমজম কূপের পানি দিয়ে ধউত করে শক্তিশালী করেন। মহানবী (সা:) এর মেরাজ শরীফ স্বশরীরে হয়েছিল। এতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। কেউ অস্বিকার করলে কাফির হবে।
বুরাকের বর্ণনা হাদিস শরীফে এসেছে এভাবে- গর্দভ হতে বড় ও খচ্চর হতে ছোট। রঙ্গ ছিল সাদা। এ প্রাণীর গতি ছিল বিদ্যুতের মত ক্ষিপ্ত এবং তার একটি পদক্ষে তার দৃষ্টির শেষ সীমানায় ফেলত। আলোর গতির চাইতেও বশি গতি সম্পন্ন। আর বারকুন শব্দের অর্থই হলো বিদ্যুত।
হযরত জিব্রাইল (আ:) মোহাম্মদ (সা:) কে বুরাকে আরোহন করিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই বায়তুল মুকাদ্দসে এসে পৌঁছলেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
1.      অনুবাদ: সেই পাক জাত যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে স্বশরীরে রাতের অল্প সময়ের মধ্যে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যমত্ম ভ্রমণ করিয়েছেন। যার আশেপাশে আমি বরকতপূর্ণ করেছি। এটা এই হেতু যাতে তাঁকে আমার কুদরাতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। (সুরা: বনি ইসরাইল:০১)।
বাযতুল মুকাদ্দাস পৌছে নবীজী বুরাক থেকে নামলেন। সেখানে নামায পড়লেন ২ রাকাত। পূর্ব থেকে অপেক্ষমান ছিলেন সকল নবীগণ। সব নবী-রাসুল হলেন মুক্তাদী আর মোহাম্মদ (সা:) হলেন ইমাম। সে সময় তিনি ইমামল মুরসালীন হিসেবে বিবেচিত হন। মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস আসতে পথে আরো অনেক আশ্চার্যজনক ঘটনা ঘটেছে। বিসত্মারিত মিরাজ সংক্রাত্ম কিতাব পড়ে জেনে নিবেন।
এক অমুসলিমের মিরাজের সত্যতা স্বীকারের ঐতিহাসিক ঘটনা: মহানবীর ( সা:) মিরাজ নিয়ে অনেক গবেষণা করা হয়েছে। যারা নাক-কান খোলা রেখে গবেষণা করেছেন তারা মিরাজের সত্যতা একবাক্যে স্বীকার করেছেন।  গবেষণা করতে গিয়ে তা সত্যে প্রমানিত হয়েছে বারং বার। এমনি একটি ঘটনা হচ্ছে, যা তাফসিরের ম’রেফুল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, হযরত  মোহাম্মদ (সা:) হযরত দেহইয়া ইবনে খলিফার মাধ্যমে পত্র লিখেন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে। রোম সম্রাট ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। চিঠি পাওয়া মাত্র মহানবী সম্পর্কে জানার জন্য তার আগ্রহ বেড়ে গেল। তাই আরবের কোন লোক পাওয়া গেলে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসার কথা বলা হলো। সে সময় আবু সুফিয়ান ইবনে হরব বানিজ্যের জন্য রোম সম্রাজ্যে ছিলেন। তখন তিনি ইসলাম বিরোধী ছিলেন। তাকে উপস্থিত করে জিজ্ঞাসা করা হলো মোহাম্মদ (সা:) কেমন লোক? তার ইচ্ছা ছিল এমন বক্তব্য দেয়া যাতে মোহম্মদ সম্পর্কে তার ধারণা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়। আবু সুফিয়ান মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করেন যাতে সম্রাট এটা বিশ্বাস করবে না। তাই আবু সুফিয়ান বললেন: আমি তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা বলতে চাই, নবুওয়াতের দাবীদার এ ব্যক্তি এক রাতে মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ভ্রমণ করেন এবং ভোরে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। সম্রাটের পিছনে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাসের সর্বপ্রধান ধর্মযাজক ও পন্ডিত। এ কথা বলার সাথে সাথে ধর্মযাজক বলে উঠলেন: আমি সে রাত্র সম্পর্কে জানি। রোম সম্রাট তার দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি কিভাবে জানেন? তিনি বললেন: আমার অভ্যাস ছিল রাতে বায়তুল মুকাদ্দসের সব দরজা বন্ধ না করা পর্যত্ম নিদ্রা যেতাম না। সে রাত্রে আমি সব দরজা বন্ধ করলেও একটি দরজা সর্ব শক্তি দিয়ে বন্ধ করতে পারলাম না। অবশেষে কর্মচারীদের ডেকে  এনে সম্মিলিত শক্তি দিয়ে বন্ধ করতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। আমাদের মনে হচ্ছিল যেন আমরা এক পহাড়ের সাথে দাক্কা দাক্কি করছি। কর্মকার ও মিস্ত্রি এনে চেষ্টা করে পারা গেল না। তারা বলল: দেয়াল চেপে বসেছে। কাল দিনের বেলায় দেখা যাবে। আমরা দরজা খোলা রেখে চলে আসলাম। সকাল হওয়া মাত্র সে দজার নিকট গেলাম। দেখলাম মসজিদের দরজার কাছে একটি চিদ্র করা একটি প্রস্তর খন্ড পড়ে আছে। মনে হচ্ছেল এখানে কোন জন্তু বাঁধা ছিল। তখন আমি সঙ্গীদের বলেছিলাম- হয়তো আলস্নাহর কোন প্রিয় বান্দা আগমন করেছিলেন। তিনি এও বলেন: সে রাতে আলস্নাহর প্রিয় বান্দা নামাজও পড়েন। আর এভাবে একজন অমুসলিমের মূখ থেকে মিরাজের সত্যতা বের হয়ে আসলো।
উর্ধ্বাকাশ পানে যাত্রা: এরপর জিব্রইল আ: নবীজীকে বুরাকে আরোহন করিয়ে উর্ধবাকাশের দিকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে উপনীত হয়ে হযরত আদম (আ:) এর দর্শন লাভ করলেন। এ সময় আদম আ: এর ডান দিকে নেককার আর বাম দিকে পাপিদের রূহ দেখানো হয়। এরপর দ্বিতীয় আসমানে গিয়ে হযরত ইয়াহ ইয়া (আ:) এবং ঈসা ইবনে মারয়াম (আ:) এর সাথে সাক্ষাত হয়। অত:পর তাকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হযরত ইউসুফ আ: এর সাথে সাক্ষাত হয়। এরপর চতুর্থ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হযর ইদ্রিস (আ:) এর সাথে সাক্ষাত হয়। এরপর পঞ্চম আসমানে গিয়ে হযরত হারুন (আ:) এর সাথে সক্ষাত হয়। ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ:) এর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর সাথে দেখা হয়। ইব্রাহমি (আ:) কে দেখলেন বায়তুল মামুরে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার আশপাশে অনেক ছোট বালক- বালিকা খেলছে। এ শিশুরা হচ্ছেন যারা শিশু অবত্মায় মারা গেছে তারা।
প্রত্যেক নবীর সাথে সালাম বিনিময় হয় এবং সকলে মোহাম্মদ (সা:) এর নবুওয়াতকে স্বীকারোক্তি করেন। প্রতিটি আসমানের দুরত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা:) বলেন: যমীন থেকে আসমানের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ।
বায়তুল মামুর হলো- ফেরেশতাদের কিবলাহ। বায়তুল মামুরকে প্রতিদিন  সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ  করেন। যারা একবার তাওয়াফ করেছেন  তারা কিয়ামত পর্যত্ম দ্বিতীয়বার তাওয়াফ করার সুযোগ পাবেন না।
সিদরাতুল মুনতাহার দিক রওয়ানা: ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে- বড়ই গাছ বা কূলবৃক্ষ। কেউ কেউ এটাকে ‘শাজরাতুল মুতনতাহা’ তথা শেষ সীমান্তের গাছ বলেছেন। সপ্তম আসমানের  উপরে উঠার কারো ক্ষমতা নেই। সকলের জন্য এটা হলো শেষ সীমানা। তেমনি উপরে যে সব ফেরেশতা আছেন তাদের নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। সপ্তম আসমানের উপরে যারা আছেন তাদের নিচে আসার কোন ক্ষমতা নেই এবং আসেনও না। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট রয়েছে জাননাতুল মাওয়া। যেমন- কুরআন শরীফে বলা হয়েছে-‘‘ইন্দা সিদরাতিল মুনতাহা, ইন্দাহা জান্নাতুল মাওয়া’’। অনুবাদ: সিদরাতুল মুনতাহার নিকটেই রয়েছে জন্নাতুল মাওয়া।’ সপ্তম আকাশের উর্ধ্বে যাবেন না বলে জিব্রাইল (আ:) জনিয়ে দিলেন। এমনকি বলেন, এখন থেকে বুরাক বাহনও যাবে না। কিভাবে যাবেন আলস্নাহ পাক ভালো জানেন। এখন আরো গতি সম্পন্ন বহন প্রয়োজন। তাঁর সামনে আনা হলো মন মুগ্ধকর সবুজ রঙ্গের এক সিংহাসন।  তিনি এটার উপর আরোহন করলেন। সেই বাহনের নাম ‘রফরফ’। রফরফ চলছে সূর্যরশ্মির চাইতে ক্ষিপ্রতর গতিতে উর্ধ্বলোকে। রফরফে আরোহনের পর থেকে আলস্নাহর সান্নিধ্যে যাবার আগ পর্যমত্ম অনেক বিচিত্র ঘটনা দেখেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, একটি বিরাট আকারে মোরগ দেখলেন। এটা একজন ফেরেশতা। লেজের পালকগুলো ছিল মুক্তার তৈরী। ডানা দুটি যেন আসমান জমিন জুড়ে রেখেছে। তার শরীর থেকে আল্লাহর নুর ঝড়ছে। সেই নুরে সর্বময় উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে। এ মোরগরূপী ফেরেশতা শেষ রাতে বলেন, ‘সুবহানল মালিকিল কুদ্দুসি।’ এভাবে প্রতি রাতে আল্লাহর মহিমা গাইতে থাকে। তখন এ দুনিয়ার মোরগগুলো তাঁর সাথে সুর তুলে শেষ রাতকে মুখরিত করে তুলে। মহান আল্লারহ সাথে সাক্ষাত হলো। সালাম বিনিময় হলো। আসার সময় উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসলেন। পৃথিবীতে চলে আসলেন। সকাল বেলায় কাবার আঙ্গিনায় সকলের নিকট পবিত্র মিরাজের বর্ণনা দিলেন। এ নিয়ে কাফিরদের মাঝে কৌতুহল শুরু হলো। মুসলমনদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করতে বিলম্ব হচ্ছে। কাফিররা রীতিমত মহানবী সা: কে পাগল, মাতাল বলতে শুরু করলো। অন্য দিকে হযরত আবু বকর (রা:) মিরাজের ঘটনাটিকে বিনা প্রমানে বিশ্বাস করে নিলেন। বিনিময়ে তিনি মহানবীর পক্ষ থেকে ‘সিদ্দীক’ উপাধী লাভ করলেন। মিরাজের ঘটনাটি কাফিরদের বিশ্বাস করাতে একের পর এক প্রমান দিতে লাগলেন। কিন্তু কাফিররা জ্বলমত্ম প্রমান পাওয়ার পরও মেনে নিতে পারেনি। এই ছিল পবিত্র মিরাজের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
মিরাজের ঘটনা দৈহিক না স্বপ্ন: পবিত্র মিরাজে ঘটনাটি নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে  কোন মতভেদ নেই। মতবদ দেখা দিয়েছে তা সরাসরি দৈহিক  না স্বপ্ন যুগে। মহানবী (সা:) এর মিরাজ স্বপ্ন যুগে নয় বরং তা ছিল জাগ্রত অবস্থায়। তা যুগে যুগে ইসলামী চিমত্মাবিদগণ প্রমান করে এসেছেন। আমরা সেখান থেকে দলিল নিয়ে সংক্ষিপ্তকারে প্রমাণের চেষ্টা করবো।
দৈহিক অস্বীকারকারীদের দলিল: দৈহিক মিরাজ অস্বীকারকারীদের মূল ভিত্তি হলো দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মনগড়া ও ভ্রাত্ম কতিপয় মূলনীতি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে-
1.      উর্ধ্বাকাশে আরোহনের জন্য আকাশ বিদীর্ণ হওয়া প্রয়োজন। আর এটি যেহেতু অসম্ভব ব্যাপার, কাজেই মিরাজ দৈহিকভাবে হয়নি।
2.     মানুষের স্থুলদেহ মধ্যাকর্ষণশক্তি অতিক্রম করে উর্ধ্বাকাশে ভ্রমন করা সম্ভব নয়।
3.    এখানে অক্সিজে নাই সেখানে গেলেন কিভাবে? সাধারণত: অক্সিজেন ছাড়া প্রাণি বাচে না।
4.      পবিত্র কুরআনের আয়াত উপস্থাপন-
ক. অনুবাদ: যে স্বপ্ন আমি আপনাকে দেখিয়েছি তা মানুষের জন্য পরীক্ষা বিশেষ। (সুরা: বনী ঈসরাইল-৬০)
খ. অনুবাদ: কোন মানুষের জন্য এমন হওয়ার নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন; কিন্তু অহীর মাধ্যমে অথবা পর্দার অমত্মরালে থেকে (কথা বলতে পারেন)। (সুরা: আশ শুরা-৫১)।
গ. মুসা (আ:) আল্লহর সাথে দেখা করতে বলেছিলেন, হে প্রভু! তোমর দিদার আমাকে দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই। (সুরা: আরাফ-১৪৩) তখন আল্লাহ বলেন: তুমি কস্মিনকালেও দেখতে পাবে না।’
বিরোধীদের যুক্তি খন্ডন: তাদের যুক্তি ও দলিলবিত্তিহীন। কারণ মহানবীর মিরাজ ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ মুযেযা। আর মুযেযা সাধারণ জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা অসম্ভব। ১ নং দলিলের জবাব: আকাশ বিদীর্ণ হওয়া এবং জোড়া লাগা  স্বাভাবিক। কারণ এটি একটি জড় পদার্থ। আর সকল জড় পদার্থই মৌলিকত্বের দিক দিয়ে একই রূপ। আর সকল  পদার্থ বিদীর্ন ও জোড়া লাগে। তা ছাড়া আসমান জমিনের মালিক ইচ্ছা করলে ফাটল ও জোড়া লাগাতে পারেন। কুরআনে বলা হয়েছে-‘‘ ওয়া ফুতিহাতুস সামাউ ফাকানাত আবওয়াবান’’। অনুবাদ: আর আকাশের অনেক দরজা খুলে দেয়া হল।’’
২নং দলিলের জবাব: ক. গতিবিজ্ঞান বলে, ‘‘পুথিবী হতে কোন একটা ভারী বস্ত্তকে যদি প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাত ৭ মাইল বেগে উর্ধ্বলোকে ছুড়ে মারা হলে মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা আর পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে না।’’ (the Univers around Us-by-j.jens-p216)  নভোচারীদের রকেট চাঁদে গমন এর বাসত্মব প্রমান। মহানবী (সা:) এর দেহ মোবারক স্থুল হলেও তাঁকে বহনকারী বুরাক সেকেনেট লক্ষ মাইল অতিক্রম করে। যা মধ্যাকর্ষণ শক্তি তা ঠেকাতে কখনো পারবে না। অতএব মধ্যাকর্ষনে দোহাই দিয়ে দৈহিক মিরাজকে অস্বিকার করা বোকামী। খ. দেখতে নবী জড়দেহী মানবরূপী হলেও তিনি ছিলেন নুরের তৈরী। যা কুরআন-হাদিসে বর্ণিত আছে। আর নুর বা আলো মধ্যাকর্ষণ শক্তি বেদ করতে কোন সমস্যা হয় না। গ. আর মিরাজ স্বপ্ন হলে বুরাক আনার কোন প্রয়োজন ছিল না। ঘ. মিরাজ স্বপ্ন যুগে হলে কাবার প্রাঙ্গণে নবীজী যখন মিরাজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন কাফিররা বিশ্বাস করছিল না। যদি স্বপ্ন হতো তাহলে সেখানে প্রমাণের প্রয়োজন হতো না। কারণ স্বপ্ন যে কোন কিছু দেখা যায়। তা প্রমাণের জন্য বৈঠক করা আর বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা জানালা কতটি প্রমান করা শর্ত দেয়ার প্রয়োজন হতো না।
৩ নং প্রশ্নের জবাব হচ্ছে: অক্সিজেন ছাড়া প্রাণী বাঁচে না এটা সত্য। কিন্তু জীবন মরন আল্লাহর হাতে। তিনি কখন স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রমও করে থাকেন। মহানবীর উর্ধ্বাকাশে ছিল মহান আলস্নাহর ইচ্ছার বহি:প্রকাশ।
৪নং দলিলের জবাব হচ্ছে- ক. অনুবাদ: যে স্বপ্ন আমি আপনাকে দেখিয়েছি তা মানুষের জন্য পরীক্ষা বিশেষ। (সুরা: বনী ঈসরাইল-৬০) এখানে ‘রুইয়াত’ শব্দের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ট মুফাসসিরের মতে স্বপ্ন অর্থে নয় দেখানো অর্থে বুঝানো  হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং বিখ্যাত মুফসসির  ইবনে আববাস (রা:) এই অর্থই করেছেন।
হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত: হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলেছেন: যখন আমাকে উর্ধ্বকাশে ভ্রমণ তথা মিরাজে নেয়া হল তখন আমার প্রভূ আমার এত নিকটবর্তী হয়েছিলেন যে আমাদের মাঝে দুই ধনুকের সম পরিমাণ ব্যবধান এমনকি তার চেয়েও কম। এমতাবস্থায় আল্লাহ আমাকে বললেন: ‘‘ হে আমার বন্ধু ! হে মোহাম্মদ (সা:)! আমি বললাম হে ল্লাহ! আমি উপস্থিত।’’ (কানযুল উম্মাল: ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১২)।
আলস্নাহ কারো সাথে কথা বলেন না-কথাটি সত্য। কিন্তু রাসুল (সা:) এর জন্য এটি খাস। আলস্নাহ পাক কুরআনে মিরাজ সম্পর্কে বলেন: অনুবাদ: সেই পবিত্র জাত যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে স্বশরীরে রাতের অল্প সময়ের মধ্যে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যত্ম ভ্রমণ করিয়েছেন। যার আশেপাশে আমি বরকতপূর্ণ করেছি। এটা এই হেতু যাতে তাঁকে আমার কুদরাতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। (সুরা: বনি ইসরাইল:০১)।
উপরোক্ত আয়াতে ‘‘সুবহান’’ তথা পবিত্র শব্দ ব্যবহৃত হয় আশ্চর্যজনক ও বিরাট বিষয়কে বুঝানোর জন্য। স্বপ্নকে নয়। অন্য দিকে আয়াতে ‘‘আবদিহি’’ শব্দ আনা হয়েছে। আবদিহি ঐ বান্দার বেলায় ব্যবহৃত হয় যার দেহের সাথে প্রাণ আছে, জাগ্রত আছে। সুতরাং মিরাজ যদি স্বপ্ন হতো সেখানে আবদিহি ব্যবহৃত হতো না। তাছাড়া সময় নিয়ে কোন বিজ্ঞ আলেম পুরো আয়াতের ব্যাখ্যা করেন তবে মিরাজ দৈহিক হয়েছে এর জন্য অন্য কোন দলিল প্রমাণের প্রয়োজন হবে না। উপরোক্ত আয়াতখানা যথেষ্ট। মিরাজ স্বপ্ন হলে আবু জেহেলারা হৈ চৈ শুরু করতো, প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য চাপ দিত না, নবীকে পাগল বলতো না। স্বপ্নে যে কোন জিনিস দেখা যায়। নিজ ঘরে নিদ্রা থেকে বৃটেন রাজপ্রাসাদে ঘুমানো যায়। তাতে কাউকে বললে প্রমানের প্রয়োজন হয় না।
পরিশেষে বলতে চাই পবিত্র মিরাজ শরীফের বর্ণনা বিশাল। সংক্ষেপে এটুকু বললাম। পাঠকগণ বিসত্মারিত জানতে মিরাজ সংক্রামত্ম বই পড়ুন। আমাদেরকে মিরাজ থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, নবীজী মিরাজে গিয়ে পাপীদের দূর্দশা দেখেছেন দূর্নীতিবাজদের আযাব দেখেছেন। আমাদেরকে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর পৃথিবী, গড়ার অঙ্গিকার আর পরকালের শান্তিময় জীবন পাওয়ার পথ তৈরী করতে হবে। আর এটাই হবে পবিত্র মিরাজের শিক্ষা।


(লেখক:শিক্ষক, আলহাজ্ব মিনা বেগম নুরানীয়া মহিলা আলিম মাদরাসা, তাজপুর, ওসমানীনগর, সিলেট।