Monday 17 March 2014

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মহাকবি শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী

উজ্জ্বল দাশ :: মহাকবি শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক। সুরমা উপত্যকায় তিনি সর্ব প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী ‘দেবীযুদ্ধ’ বই লেখার কারণে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠির রোষানলে পড়ে কলকাতা বিদ্যাসাগর সরকারী কলেজের চাকুরী হারিয়ে ছিলেন। সুখ-সমৃদ্ধি, আরাম-আয়েশ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন পেয়েছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার মন্ত্রনা ছিল তার লেখনি। তিনি লেখনীর মাধ্যমে দেশবাসীকে স্বাধীনতার দীক্ষায় উৎসাহিত ও
সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। এই কবিকে অনেকে না চিনলেও ইতিহাস তার বুকে ধারন করেছে সযতনে।

মহাকবি শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী ১২৫৯বাংলায় (১৮৫২খ্রীঃ) সিলেটের ওসমানীনগর থানার সাদীপুর ইউনিয়নের বেগমপুর গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন বলরাম চৌধুরী ও মাতা নারায়নী দেবী। অল্প বয়সে কবি তাঁর পিতা মাতাকে হারান। বিদ্যা শিক্ষার প্রতি কবির আগ্রহ ও চেষ্টা ছিল দুর্নিবার। শিক্ষার জন্য এমন কাজ নেই যা তিনি করেননি। ১১বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কবি ছাতকে যান। উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ায় পুনরায় তিনি সিলেটে ফিরে আসেন। সিলেট এসে কবি তারিনীচরণ মুন্সীর বাসায় পাচকের কাজ করেন। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ যাত্রী একদল ব্রাহ্মনের সঙ্গে সিলেট ত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে কবি কুষ্টিয়া শিয়ালদহে জনৈক কর্মকারের সাহায্যে আবার লেখাপড়া শুরু করেন।
সে সময় লোকমুখে রাজশাহী জেলার পুটিয়ার রানী শরৎসুন্দরী দেবীর মহানুভবতার কথা শুনে শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী রানীর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টায় ব্রতী হন। এক সুযোগে তিনি রানীর দরবারে নিজ দুঃখকথা ‘কাব্যনবোদ্যম’ নামে স^রচিত একটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতা শুনে রানী শরৎসুন্দরী দেবী মুগ্ধ হয়ে কবির শিক্ষার্জনের সুযোগ করে দেন। রানী সান্নিধ্যে তিনি ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহী উচ্চ বিদ্যালয়ে হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি করানো হয় কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে। ১৮৮২সালে কবি তৎকালীন আসাম রাজ্যের তৃতীয় গ্রেজুয়েট হওয়ার সম্মান অর্জন করেন।
শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী কর্ম জীবনের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। জ্ঞানাজর্নের ক্ষুধা নিয়ে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলার বিভিন্ন জায়গায়। কথিত আছে, শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী যে বিষয়ে ছাত্রদের পড়াতেন সে বিষয়ে তিনি আগে পড়াশুনা করতেন। তিনি ‘জানেন না’ এমন কোন শব্দ তাঁর অভিধানে ছিল না। কোমলমতি শিশুদের জন্য তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে ‘ছোটদের বর্ণমালা শিক্ষা’ নামে বই লেখে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৮৪সালে শিলচর নরমাল স্কুলের শিক্ষক প্রখ্যাত পন্ডিত ভরতচন্দ্রের কন্যা মুক্তকেশী দেবীকে বিয়ে করেন। বিয়ের ৩-৪বছরের মধ্যে মুক্তকেশী দেবী পরলোক গমন করেন। সাংসারিক জীবনে শরচ্চচন্দ্র চৌধুরীর কোন সন্তান সন্ততি ছিল না।
১৮৮৬সালে নিজ গ্রামে শরৎসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয় নামে বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি সে বিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান অতুলনীয়। শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী নিজ উদ্যোগে বেগমপুর গ্রামে ২টি পুকুর ও একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন।
শেষ জীবনে কবি দেশব্রতী ও মাতৃসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। অসাম্প্রদায়িক শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী সমগ্র জগতের কল্যাণের নিমিত্তে অন্নত্যাগ করে সামান্য ফলমুল খেয়ে শিবপুর মহাশ্মশানে সুদীর্ঘ মাসকাল কঠোরভাবে তপস্যা করেন (১৩৩১-৩২ বাংলা)। শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী উনিশ শতকের একজন অন্যতম প্রতিভাবাপন্ন কবি ছিলেন। বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর নিজস্ব রচনাশৈলী দিয়ে। তিনি শিশু সাহিত্য রচনায়, সাংবাদিকতায়, রাজনীতিতে অসামান্য অবদান রাখেন। মানবতাবাদী মহাকবি শরচ্চচন্দ্র চৌধুরী ১৩৩৩বাংলার ১৩ফাল্গুন (১৯২৬খ্রীঃ) চিরবিশ্রাম লাভ করেন।