Monday 23 December 2013

ভালোবাসার শেষ প্রহর

তানজিনা হোসেন :: বিমানের জানালা দিয়ে যে আকাশ দেখা যায়, তা প্রতিদিনের চেনা আকাশ নয়এই আকাশ ধোঁয়াটে, কুহেলিকাময়জানালার শাটার নামিয়ে দেন তিনিহাঁটু দুটো টনটন করছেআরও কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে কে জানে? এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে এসে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল জুঁইমা, ছুটিটা পেয়েই আমি প্লেনে উঠবতুমি একা যেতে পারবে তো? একা?
হ্যাঁ, একাই তোসত্যি একা হয়ে গেলেন বনলতাপ্রথম দিনটির কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ছেকত দিন আগের কথাআজকাল ধূসর হয়ে এসেছে স্মৃতিগুলোতার পরও মনের আকাশে স্পষ্ট সেই অস্থির চঞ্চল মুখটাতুমি নাকি গান জানো? ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে তোমাকে গান গাইতে হবেমাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেনমফস্বলের স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া এক কথা, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এত এত মানুষের সামনে স্টেজে ওঠা? অসম্ভব! কাঁচুমাচু মুখ দেখে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, সেকি? কথা বলছ না কেন? আমি নাম লিখে নিচ্ছিকী যেন নাম, বলো তো? ইয়ে, নাম? মানে আমার নাম? বনলতা চৌধুরীমুহূর্তে রাজ্যির ব্যস্ততা আর অস্থিরতা থেমে গেলকলমটা কাগজের ওপর আটকে রইল কিছুক্ষণআর কৌতুক মেশানো চোখ দুটো তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া মুখের ওপরতারপরই হা হা উদাত্ত হাসিবনলতা চৌধুরী? সেন নয়? কী সর্বনাশ! সর্বনাশের কী আছে বোঝেনি সেকিন্তু ভেতর ভেতর ঠিকই সর্বনাশের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছিলসে কি তা বুঝতে পেরেছিল?এর অনেক দিন পরে, একদিন সে সেই কথা তুলেছিলহাসতে হাসতে বলেছিলে, প্রথম দিন তোমার নামটা শুনেই কেমন বুকে দোলা লেগেছিল আমার, জানো? তুমি বুঝতে পারোনি
আগে কখনো স্বীকার করিনি, নিজেকেই যেন বলেন, বনলতা, আজ করছিআমারও লেগেছিল অমন দোলাতোমার প্রাণখোলা হাসি শুনেশুধু ওই দিনই কেন, এরপর কত কত দিন, কত কত বার, কত কিছু একই রকমভাবে অনুভব করেছি আমরাএকই গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি, একই কবিতায় বুঁদ হয়েছিএকই কান্না কেঁদেছিএকই আনন্দ, একই শিহরণ, একই উচ্ছ্বাস, একই বেদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদেরতবে আজ কেন ঈশ্বর আমায় একাকী এই বেদনার সম্মুখীন করবেন?
বিমানবালা এসে খাবার দিতে চাইলে হাত তুলে নিষেধ করলেন তিনিহূদয়টা কেন যেন অভিমানে ফুঁসে উঠছে বারবারচোখের সামনে ছোট্ট স্ক্রিনে একের পর এক ফেলে আসা দৃশ্যগুলোই দেখতে পাচ্ছেন যেনকলেজে নিত্য লেগে থাকত অশান্তি, কোন্দলএই কমিটি, সেই কমিটিক্লাস শেষে টিউশনি করতে বেরোতে তুমিফিরতে অনেক রাতেতবু কি সংসার চলে? বাদলের টাইফয়েড, শিশু হাসপাতালে ওকে নিয়ে এক মাসএক রাতে ডাক্তার জবাব দিয়ে গেলহাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছিলে, আমি দেখে ফেলেছিলামআরেকবার জুঁই গরম পানিতে পা পুড়িয়ে ফেললসেলফোনের যুগ তো নয় যে জানাবকাঁদতে কাঁদতে ওকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ছুটলামতুমি খুঁজতে খুঁজতে অনেক রাতে এলে উদ্ভ্রান্ত চেহারায়কই, তখন সেই দাঁত চেপে ঘাড় গুঁজে মেনে নেওয়ার দিনগুলোতে, নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর গ্লানিটুকু পার করার সময় কখনো এত একা লাগেনি তোঅথচ এখন সবকিছু আছেঅর্থকড়ি, সম্মান, সন্তানের সাফল্যে উদ্ভাস, ফেলে-ছড়িয়ে খরচ করার মতো সামর্থ্যতবু হাহাকারে ভরে আছে হূদয়বলো দেখি, জুঁই আর বাদল কি কখনো বুঝবে, কী দিন পার করেছি আমরা? বনলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন
একবার আমরা কক্সবাজার গেলামসমুদ্র দেখে বাদলের সেকি দাপাদাপি! আর মেয়েটা রইল ভয়ে সিঁটিয়েপানিতে নামবে নাকিছুতেই নাতুমি ওকে জোর করে নামালেজুঁইয়ের ফ্লোরিডার বিশাল বাড়িটার একেবারেই কাছে সমুদ্রজুঁই এখনো পানিতে নামতে ভয় পায়ওর মেয়েটাওবাদল বুয়েটে চান্স না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলদিন-রাত বাইরে ঘুরে বেড়াতসিগারেট ধরেছিল, দাড়ি রেখেছিলচিন্তায় চিন্তায় আমি অর্ধেকতুমি ভাবতেও পারবে না বাদল এখন কত বড় চাকরি করে মেলবোর্নেওর প্রাসাদোপম বাড়ি, ফেরারে গাড়ি আর শানশওকত দেখে আমি হতভম্বআহা, তোমাকে যদি দেখাতে পারতামভালো কি মন্দ কোনো কিছুই আমি যে কখনো তোমাকে ছাড়া উপভোগ করিনিএই প্রথমআর এই শেষ
মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের সংসারে দুটি ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে, বাড়িতে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে, গরিব আত্মীয়স্বজনকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে আর যথাবিহিত সম্মানপূর্বক উৎসব-আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যে যৎসামান্য সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা কেনা হয়েছিলছেলেমেয়ের প্রাসাদের তুলনায় সেটা নিতান্তই কুঁড়েঘরতবু এই কুঁড়েঘরেই আমরা বেশ অবসর জীবনযাপন করছিলামভেবেছিলাম, এখন আবার তুমি আমি আগের মতো বই পড়ে, গান শুনে, নাটক দেখে আর গল্পগাছা করে বাকি জীবনটা এবার পার করে দেবকিন্তু তোমার সারা হলেও আমার হলো শুরুবউমা অন্তঃসত্ত্বা, বাদল ফোন করে অনুনয় করে, মা তুমি একটু আসোবাবুর ছয় মাস হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে কিন্তুজুঁই লাইসেন্স পরীক্ষা দেবে, ওর দুই বছরের মেয়েটাকে দেখবে কে? মাগো, তুমি না এলে আমার পরীক্ষাই দেওয়া হবে নাআমি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগলামআর এখানে রইলে তুমিস্কাইপে দেখা হতো তোমার সঙ্গে, ফোনে কথা হয় রোজইকিন্তু এক সমুদ্র দূরত্ব দুজনের মধ্যেসেই দূরত্ব তুমি আরও বাড়িয়ে দিলে?

বিমান এবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছেযাত্রীদের চোখে-মুখে স্বস্তি আর আনন্দসবাই প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাচ্ছেবনলতা মুখ নিচু করে চোখ মুছলেনতাঁকে যেতে হবে বারডেমের হিমঘরে, যেখানে অপেক্ষা করে আছে তাঁর একজীবনের ভালোবাসার শেষ প্রহরটিআজ নিজ হাতে যবনিকা টানবেন সেই প্রেমের গল্পের