কৃষিবিদ
এম এ মজিদ :: বাংলাদেশের সবজি ফসলের মধ্যে কুমড়াজাতীয় (লাউ, মিষ্টিকুমড়া ও
চালকুমড়া) ফসলের স্থান প্রথম সারিতে (আলু ও বেগুনের পরে এর স্থান)। এ ফসল নিয়ে
দু-তিনটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কিছু এনজিও সামান্য কাজ করলেও বেপকভাবে গবেষণার কাজ নিয়ে কেউ তেমন
কাজ করছে না।
প্রতি বছর বিভিন্ন রোগ ও পোকা দ্বারা কৃষক ব্যাপক তিগ্রস্ত হন; তাই কৃষক ভাই ও
কৃষি শিক্ষার সুবিধার্থে নিচে কুমড়াজাতীয় (লাউ, মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়া) ফসলের রোগ
ও পোকামাকড়ের লণ ও দমন ব্যবস্থা দেয়া হলো :
(ক)
রোগ
ডাউনি মিলডিউ : সিজোডিউপারসোনোসপোরা কিউবেনিস নামে
এক ধরনের ছত্রাকের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। লণ : (১) গাছের বয়স্ক পাতায় প্রথমে এ
রোগ দেখা যায়। (২) আক্রান্ত পাতায় সাদা বা হলদে থেকে বাদামি বণের্র তালির মতো
কোণাকুণি দাগ দেখা যায়। (৩) নতুন পাতা আক্রান্ত হয়ে মরে যায়। (৪) মাঝের পাতা
প্রথমে আক্রান্ত হয়। পরে সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। (৫) আক্রান্ত ফল আকারে ছোট হয়, ফলন
কমে যায় ও ফল স্বাদহীন হয়ে যায়। প্রতিকার : (১) আগাম জাতের ফসলে এ রোগ কম হয়। (২)
সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। (৩) সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। (৪) তে পরিষ্কার
রাখতে হবে। (৫) ফসলের পরিত্যাক্ত অংশ ধ্বংস করতে হবে। (৬) রোগ দেখামাত্র আক্রান্ত
পাতা তুলে ফেলতে হবে। (৭) ম্যানকোজেব অথবা মেটালেক্সিল+ম্যাকোজেব ছত্রাকনাশক প্রতি
লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশে স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি
মিলডিউ : ওডিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের মাধ্যমে
এ রোগ হয়ে থাকে এবং সব পাতার ওপর পাউডারের মতো দেখায়। লণ : (১) কুমড়াজাতীয় ফসলে
বাড়ন্ত অবস্থায় এ রোগ বেশি দেখা যায় (তবে যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে)। (২) প্রথমে
পাতার ওপর অসম আকৃতির গোলাকার পাউডারের মতো দাগ দেখা যায়। (৩) দাগগুলো বৃদ্ধি পেয়ে
সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। (৪) সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় তাই গাছ দুর্বল হয়ে
পড়ে। (৫) গাছে ফুল ও ফলের সংখ্যা কমে যায়। (৬) মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে গাছ মরে
যায়। প্রতিকার : (১) গাছের পরিত্যক্ত অংশ ধ্বংস করতে হবে ও বিকল্প ফসল চাষ করতে
হবে। (২) সুষম মাত্রায় সার ও সেচ ব্যবহার করতে হবে। (৩) সালফার প্রতি লিটার পানিতে
২ গ্রাম হারে মিশে ১০ দিন পরপর দু-তিনবার অথবা ম্যানকোজেব+মেটালেক্সিল ২ গ্রাম বা
হেক্সাকোনাজল প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি বা কার্বেন্ডাজিম প্রতি লিটার পানিতে ১
গ্রাম হারে মিশে ১০ দিন পরপর দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে।
গামি স্টেম ব্লাইট : ডিডাইমেলা ব্রাইউমি ও ফোমা
কিউকারবিটাসেয়ারাম ছত্রাকের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। লণ : (১) জীবাণু দিয়ে গাছের
কান্ড, পাতা ও ফল আক্রান্ত হয়। (২) পাতায় পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। (৩) অনুকূল
পরিবেশে দাগগুলো বৃদ্ধি পেয়ে গাঢ় বাদামি রঙ দেখায়। (৪) পরে পাতা পচে যায় এবং
কান্ডে বিস্তার লাভ করে। (৫) আক্রান্ত কান্ড ফেটে আটার মতো রস বের হয়। অনুরূপভাবে
ফলও আক্রান্ত হয়ে ঝরে পড়ে। প্রতিকার : (১) সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
(২) রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে। (৩) জমি পতিত রাখতে হবে এবং রোগাক্রান্ত গাছ
সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। (৪) রোগ দেখামাত্র ম্যানকোজেব অথবা
ম্যানকোজেব+মেটালেক্সিল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশে ৭-১০ দিন পরপর
দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে।
ঢলে
পড়া : ফিউজারিয়াম অক্সিজপোরিয়াম নামে ছত্রাকে এ রোগ হয়ে থাকে। লণ : আক্রান্ত গাছের
পাতা প্রথমে নেতিয়ে পড়ে। পরে
আস্তে আস্তে কান্ড এমনকি সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে। আক্রান্ত গাছের কান্ড মাঝ বরাবর
ছিঁড়ে ফেললে কোষ বিবর্ণ হতে দেখা যায়। মাটির রোগজীবাণু গাছের শিকড় নষ্ট করে দেয়।
ফলে শিকড় দিয়ে পানি ও খাদ্য চলাচল করতে না পারায় গাছ ঢলে পড়ে। প্রতিকার : (১) শস্য
পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। (২) রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে। (৩)
রোগাক্রান্ত গাছ ধ্বংস করতে হবে এবং প্রয়োজনে পরবর্তী বছর অন্য ফসল চাষ করা যেতে
পারে। (৪) রোগ দেখা দেয়ামাত্রই কার্বেন্ডাজিম ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১
গ্রাম হারে মিশে গাছের গোড়া ভিজিয়ে দিতে হবে
অথবা ডাইফেনোকোনাজল+প্রোপিকোনাজল-ইভাইল্ট অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
এনথ্রাকনোজ
: কোলিট্রোটিকাম অরবিকুলারি ছত্রাকের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। লণ : (১) জীবাণু
গাছের পাতা, কান্ড ও ফলকে আক্রমণ করে। (২) রোগাক্রান্ত পাতায় বাদামি থেকে ধূসর দাগ
পড়ে। (৩) দাগগুলোর চার পাশে কালো রঙের বেষ্টনী তৈরি
করে কেন্দ্র থেকে খসে পড়ে। ফলে পাতায় ছিদ্র দেখা যায়। (৪) কান্ড আক্রান্ত হলে ধূসর
হয়ে মরে যায়। (৫) আক্রান্ত ফলে বাদামি বৃত্তাকার দাগ দেখা যায়। প্রতিকার : (১)
শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে। (২) রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। (৩) পরিমিত সেচ
ও সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। (৪) বপনের আগে বীজ শোধন করতে হবে (ভিটাভেক্স ২০০
ব্যবহার করা যেতে পারে)। (৫) রোগ দেখামাত্র প্রোপিকোনাজল/হেক্সাকোনাজল/টেবুকোনাজল
প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশে ১২-১৫ দিন পরপর দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে।
ভাইরাসজনিত রোগ : কিউকাম্বর মোজাইক ভাইরাস, স্কোয়াস
মোজাইক ভাইরাস, ওয়াটারমেলন মোজাইক ভাইরাস ও জুনিকি ইয়েলো মোজাইক ভাইরাস লাউ,
মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়াতে আক্রমণ করে। লণ : (১) কচি পাতায় হলুদ ও গাঢ় সবুজ পাতায়
মোজাইকের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। (২) আক্রান্ত গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত
হয়। (৩) ফল চোট ও কম হয় ফলে ফলন কমে যায়। (৪) এপিড পোকা এ রোগজীবাণু এক গাছ থেকে
অন্য গাছে ছড়ায়। প্রতিকার : (১) সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। (২) রোগ দেখা
দেয়ামাত্র অসুস্থ গাছ তুলে ধ্বংস করত হবে। (৩) কীটনাশক যেমন ইমিডাকোরোপ্রিড প্রতি লিটার
পানিতে ১ মিলি হারে মিশে প্রয়োগ করলে বাহক পোকা দমন করা যেতে পারে।
(খ)
পোকামাকড়
লাল
পাম্পকিন বিটল : পূর্ণবয়স্ক পোকা লম্বায় ৫-৮ মিলি, প্রায় আয়তাকার ও চকচকে কমলা
লাল। এদের ডিমের রঙ হলুদ যা গাছের গোড়াতে দেখা যায়। লণ : (১) পূর্ণবয়স্ক পোকা পাতা
ছিদ্র করে খায়। (২) ফোঁটা ফোঁটা
দাগ সৃষ্টি করে। (৩) এরা ফুল ও ফল থেয়ে নষ্ট করে (মাটিতে থাকলে বেশি নষ্ট করে)।
(৪) মাটির নিচে শিকড় ও কান্ড ছিদ্র করায় গাছ ঢলে পড়ে। (৫) পোকা সদ্য গজানো বীজ
থেকে বীজপত্র খেয়ে চারা নষ্ট করে। প্রতিকার : (১) চারাবস্থায় আক্রান্ত হলে হাত
দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে। (২) গাছে শুকনা ছাই প্রয়োগ করতে হবে। (৩) গাছের
গোড়ার মাটি আলগা করে কীড়া মারতে হবে। (৪)তে ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে
হবে। (৫) পোকা মারার জন্য যেমন সাইপারথিয়ন (রিপকর্ড/রেলোথিন/বিকোথিন) অনুমোদিত
মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
কুমড়াজাতীয় ফলের মাছি : এ মাছি চেনার সহজ উপায় হলো
স্ত্রী মাছির পেছনে লম্বা নলের মতো ডিম পাড়ার অঙ্গ থাকে। লালচে বাদামি মাছির ঘাড়ে
হলুদ দাগযুক্ত রেখা আছে। লণ : (১) স্ত্রী মাছি কচি ফল ছিদ্র করে খোসার নিচে ডিম
পাড়ে। (২) ফলের ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মতো তরল বের হয়ে আসে, যা বাদামি হয়ে
শুকিয়ে যায়। (৩) ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেয়ে বড় হতে থাকে। (৪) আক্রান্ত
ফল বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়ে যায় বা পচে ঝরে পড়ে।
প্রতিকার
: (১) উত্তমরূপে জমি চাষ করে কীড়া পাখিকে খাওয়াতে হবে। (২) আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে
ধ্বংস করতে হবে। (৩) ফেরোমন ফাঁদ বা আলোর
ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। (৪) বিষ ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা মারা যেতে পারে। (৫)
ল্যামডা সাইহ্যালেথ্রিন বা ডেলামেথ্রিন ১ মিলি লিটার পানিতে মিশে ১০-১৫ দিন পরপর
দু-তিনবার স্প্রে করলে পোকা দমন করা যায়।
লালুদ্র
মাকড় : এদের গায়ের রঙ কমলা লাল থেকে গাঢ় বাদামি।
লণ : (১) কুঁড়ি ও পাতার উল্টো পৃষ্ঠা থেকে রস চুসে খায় ফলে আক্রান্ত অংশ বিন্দু
বিন্দু হলুদ ও পরে সাদা হয়ে যায়। (২) কোরোফিল শূন্যতায় পাতার আকৃতি বিবর্ণ হয়ে
যায়। (৩) গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। (৪) পাতার শিরা বরাবর সাদা বণের্র দাগ মাকড়
আক্রমণের প্রধান লণ।
প্রতিকার : (১) বেশি করে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
(২) আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। (৩) সালফার প্রতি লিটার পানিতে
৪.৫ গ্রাম বা ১০ লিটার পানিতে ৪৫ গ্রাম মিশে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। ।
লেখক
: পি-এইচ ডি গবেষক, রাবি
সুত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত